রনজক রিজভী –
বিশ্বকবি, মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি সাহিত্য সৌধের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর অসাধারণ সব সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে করেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত। সাহিত্যের সব অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের ছিল সমান পদচারণা। যেখানে তাঁর চিন্তা-দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কখনও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। সহজ, সামগ্রিক এবং সাম্য ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ সৃষ্টিকর্মে। উদার সংস্কৃতির জগত তাঁকে বাঙালির আত্ম-অন্বেষণে যেমন সহায়তা করেছে। তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির রূপকারও হয়ে উঠেছেন। অসা¤প্রদায়িক মানবতাবাদী সংস্কৃতি বিকাশে যাঁরা অগ্রগন্য; তাঁদেরও বাতিঘর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি অনেক বিতর্কের বেড়াজাল ভেদ করেছেন। তীব্র বিরোধীতার মুখোমুখি হয়েও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কবি এবং সকল সংকটে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে আছেন আজও।
রবীন্দ্রনাথ অবিভক্ত ভারতের কবি। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক শ্রেণীর রক্ষনশীল শিক্ষিতরা তাঁকে ভারতীয় এবং হিন্দু কবি বলে প্রচার শুরু করেন। তাদের দাবি এবং পাকিস্তানের বিদ্বেষের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা সংকুচিত হলেও থেমে থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহত থেকেছে। তাঁর সাহিত্যকর্মে অসাম্পদায়িক চেতনার জয়োগান ক্রমেই ধ্বনিত হতে থাকে। একটি সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বলয় থেকে রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের কবি হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথের অসা¤প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ অনুসন্ধানে ধর্মচিন্তা ঘুরে দেখা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপূরুষরা উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথের ষষ্ঠতম পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন ‘ঠাকুর’ পদবী লাভ করেন। এরপর তাঁর উত্তরসূরীরাও নামের শেষে যুক্ত করতে থাকেন ঠাকুর পদবী। পঞ্চানন ঠাকুরের আদি নিবাস ছিল যশোরে। সেখান থেকে তিনি তৎকালীন কলকাতার গোবিন্দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পূর্বপুরুষদের এই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু ব্রাহ্মণ বলা যাবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারি ছিলেন। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রবর্তিত ‘ব্রাহ্মধর্ম’ ছিল- উদার এবং মানবিক এক ধর্ম বিশ্বাস। তাঁর সংস্পর্শে এসে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারণা বদলে যায়। এবং পৌত্তলিকতা বর্জন করেন। সেই অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী একেশ্বরবাদী ছিলেন।
ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্ম সমাজদের কোনো মূর্তি নেই। জ্ঞান-ভিত্তিক আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তাধারার ভিত্তিতে ব্রাহ্ম মতের ভিত্তি স্থাপিত। তৎকালে অনেক শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী হিন্দু এ মতের অনুসারী হন। তবে রাজা রামমোহন রায় কোনো ধর্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেননি। সম্পাদন করেন একটি দলিল। সেখানে উল্লেখ আছে, একেশ্বরের উপাসনা এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে উপাসনায় যোগ দিতে পারবেন এবং কোনোরূপ চিত্রকর্ম, প্রতিমূর্তি, প্রতিমা বা খোদিত মূর্তি এ উপাসনায় স্থান পাবে না। অথচ দেবেন্দ্রনাথ নিজ গৃহে ব্রাহ্মমন্দির স্থাপন করেন। এবং সেখানে নিয়মিত উপাসনা ও ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈশব থেকে এ ধরনের সঙ্গীত শ্রবণের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছেন। তাঁর বাবা ফরাসি কবি রুমী ও হাফিজের ভক্ত ছিলেন। ইসলামের সুফিবাদ ও বাউল মতাদর্শের প্রতি ভীষণ আকর্ষণও ছিল তাঁর। ছেলেদের ফারসি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য বাড়িতে ফারসি মুন্সীও নিয়োগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মানস গঠিত হয়েছে বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শে। যে কারণে তাঁর সাহিত্যে এর প্রচ্ছন্ন প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। বলা হয়ে থাকে, বাল্যকাল থেকে উদার চেতনা ও বিশ্বাসের মাঝে বেড়ে ওঠার কারণে রবীন্দ্র সাহিত্য হিন্দু, ব্রাহ্ম, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের লোকেরাও খুব সহজে গ্রহণ করেছে।
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার জন্য প্রথম কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউল মতবাদের একটি সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি বাউল গানের ভাব সাধনা এখান থেকেই উলোটপালোট করে দেখেছেন। জেনেছেন বাউলদের সম্পর্কেও। সংগ্রহ করেছেন বাউল গান। আর এই বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁকে কখন আকৃষ্ট করেছিল, তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। যার প্রভাব তাঁর বেশ কিছু গানে রয়েছে। বাউল মতবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে একজন বড় মাপের আবিস্কারক, এ প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে। তখন লালন ফকিরের আনুমানিক বয়স ৮৭ বছর। রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর তিন মাস বয়সে ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ আগস্ট ১৯৪১) পরলোকগমন করেন। আর লালন ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর প্রায় ১১৬ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩০ বছর। এই সূত্রে বলা যায়, জমিদারীর কারণে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে লালন ফকিরের জীবিতকালেই জেনেছিলেন। যা তিনি শিলাইদহে না এলে এই সুযোগ পেতেন না। তাঁর প্রাণধর্মের প্রেরণা আর বাউলের প্রেরণার উৎস ছিলো অভিন্ন। তাই বাউলের ‘মনের মানুষ’-তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র একটি ঐক্য ও সাযুজ্যবোধ সহজেই আবিস্কার করা সম্ভব। বাউলগানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানববাদী জীবনচেতনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন। একারণে নিজে রবীন্দ্র বাউল বলেও ভেবেছেন।
জমিদারী পরিচালনার সূত্রে শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বাউল-ফকির ও বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর সংস্পর্শে আসেন। এখানেই বাউলগানের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটে। এই শিলাইদহেই বাউল-সংস্পর্শ লাভের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘হারামণি’র ভূমিকায় নিজেই বলেছেন : “শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউলদের সঙ্গে আমার সর্ব্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞতসারে বাউলসুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল, ‘কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে/ হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে/ দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে। ‘এ থেকেও খুব সহজে অনুমেয় তিনি বাউলদের ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
অসা¤প্রদায়িক উদার চেতনার কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন-চৈতন্যকে গভীরভাবে আলোড়িত করতে পেরেছিলেন। হয়েছেন সবার স্বস্তির ঠিকানা। উৎসব-পার্বন থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি অনুসঙ্গেও মিশে আছে। যেখানে ব্যক্তি আর ধর্মচিন্তা মিশেছে গভীর এক গহ্বরে। প্রাণে আর প্রকৃতিতে শুধু ধ্বনীত হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথের গানের কথা- ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি…
You cannot copy content of this page
Leave a Reply