॥ আদিত্য শাহীন ॥
কুষ্টিয়াকে নিয়ে আমি অন্যরকম স্বপ্ন দেখি। এই শহরের পরিচিতি হওয়া উচিৎ “সংবাদ শহর” হিসেবে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই নামে একটি ওয়েব প্লাটফরমের জন্য ডোমেইন রেজিষ্ট্রেশন করে রেখেছিলাম। স্বপ্নগুলো নিয়ে আমার মতো করে এগিয়ে যাবো, এই আশায়। অনেক মানুষকে স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করবো এই বিশ্বাসে। পেশাগত ব্যস্ততায় সেটি এর মধ্যে সম্ভব হয়নি। হবে আশা করি। “সংবাদ শহর” নিয়ে আমি বহুদূর যেতে চাই। শহরের প্রবেশ মুখেই একটি বিশাল মনুমেন্ট দেখতে চাই সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ছবি, সংবাদপত্র ও মুদ্রণযন্ত্রের ফিউশনে। এই শহরে একটি সংবাদ যাদুঘর ও ইনস্টিটিউট দেখতে চাই। যেখানে বাংলা সংবাদপত্রের উৎপত্তি, ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত নানান উপাদান শোভা পাবে। প্রদর্শিত হবে ঐতিহাসিক সব অলোকচিত্র। সেখানে কুষ্টিয়ার কৃতি সব সাংবাদিকের কীর্তি ছবি ও ব্যবহৃত নানা উপকরণ থাকবে। থাকবে সাংবাদিকতার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ নিয়ে এক ঝলকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা পাবার মতো উপকরণ। সেখানে একটি মাল্টিমিডিয়া ও লাইট এন্ড সাউন্ড শো এর ব্যবস্থা থাকবে। পৃথিবীর মানুষ এসে দেখবে এই ভূমিতে কীভাবে সাংবাদিকতা উৎকর্ষ লাভ করেছে। কীভাবে সাংবাদিক সৃষ্টি হয়েছে। তারা কীভাবে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এটি সরাসরি তত্বাবধান করবে। এখানে সংবাদিকদের শিক্ষাগত কোর্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
স্বপ্নটি প্রাথমিকভাবে এমন । এর সামনে পেছনে আরো অনেক কিছু আছে। আমি চোখে দেখতে পাই “দি সিটি অব জার্নালিজম” হিসেবে কুষ্টিয়াকে। দেখার পেছনের কারণটি অনেকের জানা। কুষ্টিয়া শহরের ছোট্ট এক আয়তনের ভেতর থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। দেশের অনেক স্থানেই সংবাদপত্র প্রকাশনার বহুমুখি প্রসার ঘটেছে কিন্তু কুষ্টিয়ার ব্যাপারটি ভিন্ন। কুষ্টিয়ার সংবাদপত্রের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের জীবন ও সংস্কৃতির ইতিহাস যুক্ত। প্রজা অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জড়িত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জড়িত। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত।
কুষ্টিয়া সংবাদ ও সাংবাদিকতার এক উর্বর ক্ষেত্র। এখানে সাংবাদিকতার অসাধারণ অনুশীলন চলে। আমি ১৯৯৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা সমাজের একজন সাধারণ কর্মী ছিলাম। আমার পরিচয় ছিল আন্দোলনের বাজার পত্রিকায়। দৈনিক আন্দোলনের বাজার একটি অসাধারণ ক্ষমতাধর সংবাদপত্রই ছিল না শুধু, সেটি ছিল একটি অঘোষিত ইনস্টিটিউটশন। আমি আন্দোলনের বাজারের নিবিড় এক সংবাদ শ্রমিক হয়ে উঠেছিলাম। পত্রিকার চার বছর বয়সে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে যুক্ত হয়েছিলাম। তখন আন্দোলনের বাজার রীতিমত কম্পিউটার কম্পোজ হয়ে অফসেটে ছাপা হচ্ছে। লেটার প্রেস যুগ বিদায় নেয়নি। অন্য পত্রিকাগুলো লেটার প্রেসে ছাপা হয়। আন্দোলনের বাজারের নিজস্ব অফসেট প্রেস। মুদ্রণ বিভাগে কাজ করেন বগুড়ার করতোয়া’র প্রেস থেকে আসা রফিক। আর তার সহকারি কুষ্টিয়ার জগতি এলাকার রিন্টু। কি অসাধারণ কর্মপরিবেশ। প্রেসের পাশেই কম্পিউটার কক্ষ। কাঁচের দরজা। সেখানে দুটি ম্যাকেনটোশ কম্পিউটার। যেখানে কম্পোজ করেন দক্ষ সব লোকজন। তাদের খুব বেশি চিনি না। বাবর আলী গেটের মাখন ভাইকে চিনি। কম্পিউটার কক্ষে স্যান্ডেল পরে প্রবেশ নিষেধ। কম্পিউটারের বিশেষ যতœআত্মি করা হয়। অযতœ অবহেলা হলে কমিউটার স্ক্রিনে মুখ ভ্যাংচানো একটি আকৃতি ওঠে। বোঝা যায়, কম্পিউটার বিরক্ত।
আন্দোলনের বাজার পত্রিকার বিশেষত্ব হচ্ছে পত্রিকার সম্পাদক মনজুর এহসান চৌধুরী নিজেই পত্রিকার সবচেয়ে দক্ষ শ্রমিক। কোনো কাজ নিজে আগে শেখেন তারপর নতুন একজন কর্মী নিয়ে তাকে শেখান। কম্পিউটারের স্বভাব ও তৎপরতা তিনি যেমন বোঝেন অন্যরা বোঝে না। তিনি নিজেই পেজ মেকাপ করতে পারেন। আবার ছাপাখানার খুনিটানিও তিনিই ভালো বোঝেন। তার এই জানাবোঝার অনন্যতায় একটি অসাধারণ কর্মপরিবেশ গড়ে ওঠে। তিনি কাজের সবটা বোঝেন বলে, কারো কাজের সম্ভাবনা ও ভালোমন্দ একঝলকে বুঝে যেতেন।
যদিও আন্দোলনের বাজারে যুক্ত হওয়ার আগে আমি তিন বছর এম এ শামীম আরজু সম্পাদিত দৈনিক সূত্রপাত পত্রিকা চালিয়েছি। তারপরও আমি আন্দোলনের বাজারের এক শিক্ষানবীশ। কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সম্পাদকের চিন্তন ও সৃজন জগতের সঙ্গে মিলতে শুরু করলো আমার কাজ। আর কয়েকদিনেই আমি আর আন্দোলনের বাজার হয়ে উঠতে শুরু করলাম হরিহর আত্মা।
মজমপুর গেটে আন্দোলনের বাজার একটি মাইলস্টোন। কুষ্টিয়া শহরের পরিচিতিমূলক একটি ঠিকানা যেন সেটি। দোতলা পত্রিকা অফিস। সন্ধ্যা হলেই রিপোর্টার ও অন্যান্য বিভাগের কর্মী আর পত্রিকার সেবাপ্রার্থীদের ভীড়ে গমগমে পরিবেশ। প্রশাসনিক বিভাগ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, অর্থবিভাগ, রিপোর্টিং, ডেস্কসহ সকল বিভাগ সরব। সবসময় কাজ আছে। আন্দোলনের বাজার কখনো ঘুমায় না। এর শুরু আর শেষ বলে কিছু নেই। আমি অফিসে ঢুকি বিকেলের দিকে। আর অফিস থেকে বের হই সকালে নতুন সূর্যের আলো মেখে, গরম পত্রিকা হাতে নিয়ে।
ভোর সকাল থেকে পত্রিকার সামনে দন্ডায়মান থাকতেন সুশান্ত নামের অসাধারণ এক ব্যক্তি। তিনি মূলত প্রহরি হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন। আমরা বলতাম সুশান্ত দা। বাড়ি মিরপুরের আমবাড়িয়ায়। চোখ দুটি রক্তের মতো লাল। মুখের এপাশ ওপাশ কলপ করা গোফ। ভরাট কণ্ঠ। এরহারা গড়নের বেশ লম্বা মানুষ। সবসময় নিরাসক্ত চিহারা নিয়ে থাকতেন অতন্দ্র প্রহরি। কোনো কিছুতে তার আগ্রহ, লোভ ও বিতৃষ্ণা ছিল না। তার কোনো নিজস্ব গল্পও ছিল না। তিনি ছিলেন এক রহস্য মানুষ।
সেসময় আন্দোলনের বাজারের ডাকসাইটে সাংবাদিক ছিলেন শামসুল আলম স্বপন, এস এম হালিমুজ্জামান, নূর আলম দুলাল ও আ ফ ম নূরুল কাদের। অন্যান্য বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলেন জামালউদ্দিন হায়দারি, রবজেল হোসেন পন্ডিত। আরো অনেকেই ছিলেন পূর্ণসময়কালীনও খন্ডকালীন। সারাদিন আন্দোলনের বাজার পত্রিকা যারা মাতিয়ে রাখতো তাদের মধ্যে ছিল নদীর ওপার থেকে আসা অফিস সহকারি মোমিন, কিশোর বয়সী কর্মী নয়ন ও শফিক। এদের মধ্যে শফিক এখনও আন্দোলনের বাজারেই। সে এখন কুষ্টিয়া শহরের দাপুটে এক সংবাদকর্মী। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন আন্দোলনের বাজারে কাজের আলাদা আলাদা খাত ও বিষয় ছিল। ভিন্ন ভিন্ন পদ পদবী ছিল, কিন্তু নিয়মিত কর্মমূল্যায়ণ, উদ্বুদ্ধকরণ সভা আর জবাবদিহিতার অনুশীলনের কারণে আন্দোলনের বাজার পরিবারে একে অন্যের মধ্যে ছিল অসাধারণ এক ভালোবাসার সম্পর্ক।
আমার দায়িত্বে ছিল নিউজের সবটা। সম্পাদনা থেকে শুরু করে মূদ্রণ ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত দেখভাল করা। আমি হাতখুলে লিখতাম। আন্দোলনের বাজারের ডেস্ক-এ বসলেই আমার কলম থেকে লেখা বেরুতো। আমার সময়কালে কেউ কোনো বিষয় নিয়ে এলেই তার মুখের কথা নিয়ে আমি প্রতিবেদন লিখে দিতাম। পাঠকের মনোযোগ আর উচ্ছ্বাস জেনে আমার উৎসাহ বেড়ে যেত। আমার রাতের কাজের সবচেয়ে নিবিড় সঙ্গী ছিলেন পেস্টিং বিভাগের সেলিম। সংবাদ বিভাগের সবাই যখন রাত দুইটা নাগাদ একে একে চলে যেতেন, তখন আমি সেলিম ভাই আর মুদ্রণ বিভাগের কর্মী। বাইরে নৈশ প্রহরী মধু। অসাধারণ ছন্দ ছিল প্রতিটি রাতের। সম্পাদক মনজুর এহসান চৌধুরী অধিকাংশ রাতেই সবকিছু তদারকি করতেন। মাঝে মাঝেই রাতে ভরপুর খাদ্য-খানার আয়োজন থাকতো। কাজের অবসরে সম্পাদক মিঠু ভাই গিটারে সুর তুলতেন। গভীর মগ্নতা এসে গেলে নতুন গান বেঁধে ফেলতেন।
আন্দোলনের বাজার পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক আনিসুজ্জামান ডাবলু সেই ভরপুর সময়ের একজন কর্মী। তিনি আন্দোলনের বাজার পত্রিকার ব্যবস্থাপনা, রিপোর্টিং সকল বিভাগের এক নিবিড় কর্মী ছিলেন। ছিলেন সম্পাদকের খুবই নিজস্ব মানুষ। তিনিই পত্রিকাটির হাল ধরে রেখেছেন। সবকিছু পাল্টে গেছে। কুষ্টিয়ায় বহু সংখ্যক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অনেক অনিয়মিত পত্রিকাও আছে। সবগুলি পত্রিকার সাংবাদিক হিসেব করলে সংখ্যাটি বিপুল হয়ে উঠবে। সবগুলি পত্রিকাও আমি চিনি না। সব সম্পাদক ও সাংবাদিকের সঙ্গে আমার জানাশোনা নেই। কাউকে কাউকে চিনি। কাউকে কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা পরিবেশের গভীর এক সাক্ষী বলে মনে হয়। কারো কারো কাজ দেখেও মুগ্ধ হই। তবে বলতেই হবে আমি যে আন্দোলনের বাজার ছেড়ে এসেছিলাম ১৯৯৯ সালে সেই আন্দোলনের বাজারের ভেতরে ছিল, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সংগ্রামী ও আপসহীন শক্তি, ছিল একাত্তরের মুক্তাঙ্গন থেকে ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্বাধীন বাংলা‘র শক্তি। ছিল দক্ষিণাঞ্চলের ইস্পাতকঠিন সাংবাদিকতার মুখপাত্র ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর ‘ইস্পাত’ এর শক্তি।
আন্দোলনের বাজার ছিল কুষ্টিয়া নয় শুধু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশীল দৈনিক পত্রিকা। তখন স্থানীয় সংবাদপত্রের মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় সংবাদপত্রের মর্যাদার ভিন্নতা ছিল। জাতীয় সংবাদপত্রকে মনে হতো ঢাকার পত্রিকা আর স্থানীয় পত্রিকাকে মনে হতো নিজেদের পত্রিকা। জেলা তথা আঞ্চলিক পর্যায়ের সকল ক্ষেত্রের প্রভাব ও সমৃদ্ধির মাপকাঠি নির্ধারক ছিল ঢাকার বাইরের সংবাদপত্র। সে কারণে, কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের পরিচিতি অর্জন থেকে শুরু করে পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এক্ষেত্রে বলতেই হবে, কুষ্টিয়ায় আন্দোলনের বাজার পত্রিকার মাধ্যমে অনেক রাজনৈতিক নেতার জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছনোর সিঁড়ি প্রস্তুত হয়েছে।
শুরুতেই সে স্বপ্নের কথা বলেছি, সে স্বপ্নটি উচ্চারণের খোরাক তৈরি হয়েছে আমার আন্দোলনের বাজার সময়ের আনন্দমুখরিত ও মগ্ন সাংবাদিকতার শক্তিটি ধারণ করে। শুরুতে একটি বাংলা সংবাদপত্রের নাম হিসেবে ‘দৈনিক আন্দোলনের বাজার’ শুনলে খুব বেশি হৃদয়গ্রাহী হতো না। দিনে দিনে মনে হয়েছে, নিয়ত মুক্তিসংগ্রামরত মানুষের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে এর চেয়ে ভালো নাম আর হতে পারে না। মানুষের জীবনের আন্দোলন যতদিন থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে আন্দোলনের বাজার। এমন শুভাশীষ পত্রিকাটির ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী, প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক, আন্দোলনের বাজার পত্রিকা।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply