আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ রমজানের রোজা যেমনটি গুরুত্ববহন করে তেমনিভাবে রমজান শেষে ঈদুর ফিতরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব এবং ঐ সময়ের কর্তব্য সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা দরকার। ঈদ শব্দটি আরবি। এর অর্থ বারবার ফিরে আসা, ঘুরে ফিরে আসা, জমায়েত হওয়া, খুশি, আনন্দ, অভ্যাস ইত্যাদি। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি প্রতি বছর বারবার ফিরে আসে। এটা আরবি শব্দ ‘আদা-ইয়াউদু’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আবার অনেকে বলেন, এটা আরবি শব্দ ‘আদত’ বা অভ্যাস থেকে উৎপন্ন। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বারবার ফিরে আসে ও মুসলমানরা এ দিনে তাদের প্রভুর নির্দেশ পালন করে আনন্দ পান তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ঈদ।
ঈদের একাধিক অর্থ থাকলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ঈদ বলতে খুশিই বুঝে থাকেন। এ খুশির ঈদ আমাদের মাঝে আসে প্রতি বছর দুইবার। একটিকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটিকে বলে থাকি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদুল ফিতর মাহে রমজানে পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন ও ক্ষুধাতুরের কষ্ট অনুভব করার সাথে
ইসলামে ঈদের প্রচলন : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে যেসব নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে ঈদ অন্যতম। হাদিসে এসেছেÑ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীর দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এ দুই দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসী উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খতার যুগে এ দুই দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দুই দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ [আবু দাউদ- ১১৩৪]
ঈদের দিনে করণীয়ঃ ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা : ঈদের দিন ভোরে ফজর নামাজ জামাতে আদায় করার মাধ্যমে দিনটি শুরু করতে হবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যদি তারা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারত তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দু’টি নামাজের জামাতে শামিল হতো। (বুখারি ও মুসলিম)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সুগন্ধি ব্যবহার করা : ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সব মানুষ সলাত আদায়ের জন্য মিলিত হন। ইবনে উমার রা: থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। ইবনে উমার রা: থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত, তিনি দুই ঈদের দিনে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। (বায়হাকি) ইমাম মালেক রহ: বলেন, আমি আলেমদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মোস্তাহাব বলেছেন। (আল-মুগনি : ইবনে কুদামাহ)। ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেছেন, নবী কারিম সা: দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। (যাদুল মায়াদ) এ দিনে সব মানুষ একত্রে জমায়েত হন, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা।
হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া : ঈদের সলাত আদায়ের জন্য তাড়াতাড়ি ঈদ গাহে যাওয়া। হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। হাদিস এসেছে, আলী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নাত হলো ইদগাহে হেঁটে যাওয়া। ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদিসটি হাসান। তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল করেন এবং তাদের মত হলো পুরুষ ঈদগাহে হেঁটে যাবেন, এটা মোস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহন করবেন না।
এক পথে গিয়ে অন্য পথে আসা : ঈদগাহে এক পথে গিয়ে অন্য পথে ফিরে আসা সুন্নাত। জাবের রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সা: ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন। (সহিহ বুখারী) অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন। এটা এ জন্য, যাতে উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। (যাদুল-মায়াদ)
তাকবির দেয়া : হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সা: ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছানো পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। যখন সলাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবির পাঠ করতেন না। ইবনে উমার রা: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবির পাঠ করতেন। শেষ রমজানের সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদুল ফিতরের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশে যখন বের হবেন ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবেন তখন গুরুত্বসহকারে তাকবির পাঠ করবেন।
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময় করা : ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন: (ক) হাফেজ ইবনে হাজার রহ: বলেছেন, ‘জোবায়ের ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সা:-এর সাহাবায়ে কিরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকা’ অর্থ- আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন (ফতহুল বারী)। (খ) ঈদ মুবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কিরাম রা: এ বাক্য ব্যবহার করতেন ও এতে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া রয়েছে।
ঈদের সালাতের আগে খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের আগে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সলাতের আগে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নাত। বুরাইদা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সা: ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সলাতের আগে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানির গোশত খেতেন। (আহমদ)
ঈদের সালাত আদায় ও খুতবা শোনা: জামাতের সাথে ঈদের সালাত আদায় করতে হবে। ঈদের সালাতের পর ইমামসাহেব দুটো খুতবা দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা ও গুণ-গান, অধিক পরিমাণে তাকবির পাঠ করবেন। তবে ঈদের সালাত আদায়কারীকে ঈদের খুতবা শুনতেই হবে এমন কথা নেই। যেমন হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী কারীম সা:-এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন, (আমরা এখন খুতবা দেবো। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে) (আবু দাউদ) আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে খুতবা শুনলে অনেক সওয়াব অর্জন করা যাবে। তাতে যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকির আছে, দ্বীনি শিক্ষাবিষয়ক কথাবার্তা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ফিরেশতাদের আগমন ও আল্লাহ তায়ালার সাকিনা ও রহমত। তাই এটা অবহেলা করে হারানো উচিত নয়।
ফিতরা আদায় করা : ঈদের সলাতের আগেই ফিতরা আদায় করে দেয়া একটি বড় ধরনের ইবাদত। প্রত্যক প্রাপ্তবয়স্ক অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, গোলাম-আজাদ সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হবে। শিশু ও গোলামের পক্ষ থেকে তার মনিব বা অভিভাবক ফিতরা আদায় করবে। এ বছর কুষ্টিয়া শহর এবং শহরতলীতে হিসাব মতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরা নির্ধারণ করেছে মাথাপিছু সর্বনিম্ন ৫০ টাকা। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথার দ্বারা সিয়ামের ক্রটি-বিচ্যুতিকে পবিত্র করা এবং মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের আগে আদায় করলে তা ফিতরাহ হিসেবে ধর্তব্য আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মতো একটি দান হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের, খুশির; হোক ইবাদতের দিন। ঈদ বয়ে আনুক শান্তি শৃঙ্খলা ও শালীন বিনোদন। ঈদকে ইবাদত হিসাবে পালন করতে চাইলে অবশ্যই উল্লিখিত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply