আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। আজ সেই ঈদের দিন আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। পুরো রোজার মাস শেষে মুসলিম সমাজে ঈদের আগমন অন্য রকমের একতটি অনুভুতি ও শিক্ষা দিয়ে যায়। এই অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে ঈদের শিক্ষায় আমরা যদি আমাদের জীবন সত্যিকারের মুল্যায়িত করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ এই বিশ্ব পরিমন্ডল সব কিছুই সরল গতিইে এগিয়ে যেত। থাকতো কোন ভেদাভেদ, কোন মনোমলিন্য ও দুঃখ কষ্টে বালাই।
ঈদ ইসলামের দু’টি প্রধান অনুষ্ঠান। ঈদের শুরু কিভাবে হয়েছিল, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দু’টি ঈদের শুরু হলো এভাবে- যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় গেলেন, তখন তিনি দেখলেন যে তারা দু’টি অনুষ্ঠান পালন করে। সেই দু’টি অনুষ্ঠান বদলে দিয়ে তিনি এ দু’টি ঈদের ব্যবস্থা করলেন। একটি হলো সফলভাবে রোজা শেষ করার আনন্দ। আরেকটি হচ্ছে হজের যে অনুষ্ঠান, যাতে বিশ্ব মুসলিম শরিক হচ্ছে মক্কায় তারই পাশাপাশি সারা বিশ্বের মুসলিমদের যুগপৎভাবে ঈদ পালন। অর্থাৎ মক্কায় হজ হচ্ছে এবং সারা দুনিয়ায় ঈদ উৎসব হচ্ছে। আবার এর সাথে ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। হজরত ইব্রাহিম আ:কে তার ছেলেকে কোরবানি করতে বলে আল্লাহ তায়ালা যে মহা পরীক্ষা করেছিলেন, সেই পরীক্ষায় তাঁর যে বিজয়, সেটাকে সামনে রেখে এ ঈদের ও হজের অনুষ্ঠান করা হলো।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, রাসূল সাঃ ওই দু’টি অনুষ্ঠান বদলে দিলেন কেন? আগের অনুষ্ঠানগুলোর ভিত্তি ছিল পারস্যের অনুকরণে। পারস্য তৎকালীন অন্যতম সুপার পাওয়ার ছিল। তাদের জাতির মধ্যে ওই অনুষ্ঠানগুলো ছিল। এসব অনুষ্ঠান মূলত কিছুটা প্রকৃতি ভিত্তিক ছিল। সে কারণে রাসুল সাঃ এসব অনুষ্ঠান তেমন পছন্দ করেননি। এ অনুষ্ঠানগুলোতে প্রকৃতিকে বেশি সম্মান দেখানো হচ্ছিল। সে জন্য তিনি এ পরিবর্তনটি করলেন। এর থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে মুসলিমদের যে অনুষ্ঠানমালা হবে, তাতে এ মূলনীতিই খেয়াল রাখা উচিত।
ইসলাম আনন্দ উৎসবকে স্বীকার করেছে। যেমন রাসূল সাঃ এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে নতুন কোনো অনুষ্ঠান চালু নাও করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা না করে তাদের ওই দু’টি অনুষ্ঠানের পরিবর্তে বিকল্প দু’টি নতুন অনুষ্ঠান দিয়েছেন। এ থেকে আরেকটি নীতি পাওয়া যায়, তা হলো- মানুষের যে সত্যিকার প্রয়োজন সে প্রয়োজনকে উপলব্ধি করতে হবে, স্বীকার করতে হবে এবং মানতে হবে। তা করতে গিয়ে যদি দেখা যায়, প্রচলিত পদ্ধতিগুলো ভালো নয়, তাহলে তার বিকল্প দিতে হবে। রাসূল সাঃ এ কার্য থেকে প্রমাণিত হয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তার বিকল্পও দিতে হবে। এ বিষয়ে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। আজকে মানুষের মধ্যে আনন্দের যে প্রয়োজন রয়েছে, তা রাসূল সাঃ স্বীকার করেছিলেন। স্বীকার করেই তিনি এ দু’টি অনুষ্ঠান দেন এবং তার নাম রেখেছেন ‘ঈদ’ তথা আনন্দ, উৎসব। তিনি অন্য নাম রাখতে পারতেন। অথচ তিনি ঈদ নাম রাখলেন কেন? একে আনন্দ উৎসবের সাথে সম্পর্ক করলেন কেন? সেটিও আরেক তাৎপর্যপূর্ণ দিক। এটি প্রমাণ করে, রাসূলু সাঃ বিখ্যাত হাদিস হচ্ছে, ইসলামে কোনো বৈরাগ্যবাদ নেই। এ ছাড়াও কুরআন মজিদে বৈরাগ্যবাদকে নিন্দা করা হয়েছে। এবং ইসলাম বৈরাগ্যবাদের ধর্ম নয়। বৈরাগ্যবাদ কোনো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নয়।
এ থেকে আমরা বলতে পারি ইসলামি সংস্কৃতির শুরুটা কী রকম হবে, তা আমরা ঈদ থেকে পাই। রাসূল সাঃ যে ঈদের ব্যবস্থা করলেন, তাতে তিনি ঈদের দিনটি শুরু করলেন নামাজ দিয়ে। তিনি ঈদুল ফিতরের দিন খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন, নতুন কাপড়-চোপড় পরতে বললেন, বেড়াতে উৎসাহিত করলেন। বেড়ানোকে ও দাওয়াত দেয়াকে উৎসাহিত করলেন। কিন্তু সাথে সাথে তিনি ঈদের দিনটি শুরু করতে হবে সালাত দিয়ে, এ ব্যবস্থা রাখলেন।
আগের দিনে আরব দেশের আমাদের মতো এত দেরিতে ঈদ হতো না। সেখানে ঈদ হয়ে যেত খুব ভোরে। তখন সূর্য ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে ঈদের নামাজ পড়া হয়ে যেত। নামাজ পড়েই বাকি কাজে লেগে যেত। এটাও ইসলামি সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে। এর বৈশিষ্ট্য হলো আমাদের আনন্দ অনুষ্ঠানের ভিত্তি হতে হবে আল্লাহকে স্মরণ করা সেটা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সালাত দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যান্য অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে আল্লাহর স্মরণে। তাই যেকোনো সুন্দর অনুষ্ঠান যদি আমরা করি ও তার শুরু হওয়া উচিত আল্লাহকে মনে করার মধ্য দিয়ে। এ বৈশিষ্ট্য আরো প্রমাণ করে, রাসূল সাঃ যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাতে কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। এর মধ্যে কোনো অপসাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অবকাশ নেই। সেখানে সব কিছুই সুন্দর। এর মধ্যে স্থান নেই কোনো ধরনের পূজার। তা মানুষেরই হোক বা প্রকৃতিরই।
আমাদের দেশের ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে সে বিষয়ে কিছু বলা দরকার। প্রথমত, ঈদে বেড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাকে এসব ব্যাপার ঠিক আছে। কিন্তু যেটুকু ঠিক নেই তা হলো, পাশ্চাত্যেরই প্রভাবে আমাদের মধ্যে অনেক অশালীন পোশাকের প্রচলন হয়েছে। এটা দূর করা সহজ ব্যাপার নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। দুনিয়ায় যেকোনো সংশোধন দাওয়াত দিয়েই সম্ভব। মানুষের মন জয় করতে হবে। মনকে জয় করেই সংশোধন আনতে হবে। কারণ, একটি ইসলামি রাষ্ট্র হবে, সেই রাষ্ট্র আইন করে এগুলো করবে, সেটা যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। তা কতটা করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা করতে পারলে ভালো। সংবিধান মোতাবেক একটি দল ক্ষমতায় এসে সংসদে আইনের মাধ্যমে এগুলো করতে পারলে ভালো। কিন্তু সেটাই করা কতটা সম্ভব হবে তা জানি না এবং এর জন্য অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। মূল জিনিস হলো সমাজের সংশোধন। কল্যাণ করতে হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যদি মুসলিম জাতির ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা দাওয়াতে বেশি সময় দেন, ইসলামের মূল ধারা, মূল্যবোধকে যদি তারা বুদ্ধিমানের মতো জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেন বন্ধুবান্ধবের কাছে, নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যে তাহলে এ সংস্কার সম্ভব বলে মনে করি।