কৃষি প্রতিবেদক ॥ দেশে গবাদিপশু তথা গরু পালন একটি লাভজনক পেশা। গরু পালন করে অনেকেই আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন, দূর করছেন তাদের বেকারত্ব। বাংলাদেশে গরুর মাংস খুব জনপ্রিয় এবং চাহিদাও প্রচুর। তাছাড়া মুসলমাদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানির সময় অনেক গরু জবাই করা হয়। গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি লাভজনক ব্যবসা। শিক্ষিত যুবকরাও ঝুঁকছে খামার ব্যবসায়। কৃষি ও পশুপালন নিয়ে প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চশিক্ষিত যুবকরাও এখন খামার ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। গরু মোটাতাজা করে সফল অনেকেই।
গরু পালনে অধিক লাভবান হতে চাইলে খামার ছোট থেকে বড় আকারে শুরু করতে হবে। দেশে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ আমাদেও দেশে মাংসের চাহিদা প্রচুর, উৎপাদন কম। এছাড়া গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে কর্মসংস্থান, গোবর উৎপাদন, চামড়া উৎপাদন, পরিবেশ উন্নয়ন এসব নানা কিছু জড়িত। একটি কথা তো সর্বজন স্বীকৃত যে, প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সময় এ দেশে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া কোরবানি করতে হয়। এ সংখ্যার ৭০ শতাংশ গরু। সুতরাং কোরবানি উপলক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ গবাদিপশু মোটাতাজা করতে হয়। কাজটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ এ দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষের নিয়মিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
গরু বাছাই করার ক্ষেত্রে মনে রাখবেন, গরুর বয়স ২ থেকে ৩ বছর হলে ভালো হয়। শংকর, ফিজিয়ান, সিন্ধি জাত হলেও ভালো। এগুলোর চামড়া ঢিলেঢালা, হারের জোড়া মোটা, ঠান্ডা প্রকৃতির, রোগমুক্ত। গরু কেনার পর প্রথম কাজ হচ্ছে গরুকে কৃমিমুক্ত করা। মুখের রুচি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। তারপরই হচ্ছে সুষম খাবার পরিমাণমতো।
একটি ছোট কিংবা মাঝারি ধরনের উন্নত জাতের গরু সমৃদ্ধ খামার, একজন যুবকের কর্মসংস্থানের ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে এজন্য খামার ব্যবস্থাপনা ভালো হতে হবে। সাধারণত একটা লাভজনক স্থায়ী খামার করতে হলে ১০০ থেকে ২০০ গরু নিয়ে শুরু করাই ভালো। কারণ তখন আধুনিক সব টেকনোলজির ব্যবহার করতে পারবেন। খামারে যত মানুষের সংখ্যা কম হবে তত জীবাণু সংক্রমণের সংখ্যাও কমে আসবে। এতে করে আপনার খামার থাকবে জীবাণু ও রোগমুক্ত। আসলে ৫০ থেকে ১০০ বা ২০০ গরু নিয়ে আপনি আধুনিকভাবে একটা খামার স্থাপন করতে পারেন। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। ফলে মানুষ দুধ পাবে, মাংস পাবে, সার পাবে।
৫০ থেকে ২০০ গরু নিয়ে একটা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে না। লাখ দশেক টাকা হলেই যে কেউ এমন ফার্ম স্টার্ট করতে পারবে। আমরা যে কাজটা করি সেটা হলো, গরুর ঘর বানাতেই ২০ লাখ টাকা খরচ করে ফেলি। পেছন ফিরে তাকালে কী দেখবেন- একসময় প্রাণীরা থাকত জঙ্গলে। এখন বাসাবাড়িতে রাখা হয়। তাও আবার দালানকোঠায়। এটা ঠিক না। যখন আপনি পশুকে ঘরের মধ্যে রাখবেন, তখন তো সেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস আসবে না। তাহলে কী করা? সে জন্য শুধু উপরে একটা কিছু দিয়ে কভার করলেই হবে। যাতে রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডা এসে সরাসরি গরুর উপর না পরে; এটুকুই যথেষ্ঠ। তাহলে চারপাশে বাতাস আসবে, বৃষ্টিতে গরু ভিজলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তাহলে কী হবে, তাদের শরীর পরিষ্কার থাকবে, বাতাস পরিষ্কার থাকবে এবং গরুর বৃদ্ধি দ্রুত হবে। শুধু মশার একটা সমস্যা আছে, তবে তার সমাধানও আছে। আজকাল বাজারে নেট পাওয়া যায়, ঘরের চারপাশে নেট লাগিয়ে দিলে মশা আর লাগবে না। তাহলে সহজেই আপনি গরু লালন-পালন করতে পারবেন। একজন শক্ত সমর্থ যুবক মাত্র ১০ লাখ টাকা খরচ করলেই এরকম একটা খামার স্থাপন করতে পারে। তাহলে তার ব্যবসাটাও ভালো হবে। যেখান থেকে প্রায় ৩০ ভাগ মুনাফা পাওয়া সম্ভব। গরু মোটাতাজা করার জন্য শুধু খাবার দিলেই হবে না। পাশাপাশি পশুকে ভালোবাসতে হবে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হবে। যেমন- সময়মতো গোসল, খাবার, ওষুধ দিতে হবে। এছাড়া ভালো ব্যবস্থাপনা, যথাসময়ে সঠিক কাজ সফলতা এনে দেবে। গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য যাদের পর্যাপ্ত ঘাস নেই, বিকল্প উপায়ে ঘাস চাষ করে গরুকে খাওয়াতে হবে। বাড়ির আশপাশে পতিত জমিতে ঘাস লাগিয়ে দিতে হবে। সেই ঘাস গরুকে খাওয়ালে গরুর খাদ্য খরচ কমে আসবে।
গরু পালনের জন্য ঘরটি মোটামুটি খোলামেলা জায়গায় হতে হবে; বাঁশ, ছন, খড়, পাটখড়ি দিয়ে ঘর নির্মাণ; ঘরের মেঝে ঢালু ও ড্রেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে- যাতে চোনা ও পানি গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। খাদ্য ও পানির পাত্রগুলো প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার করা; খাওয়া শেষ হলে পাত্রগুলো ঢেকে রাখতে হবে। গরুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত গোয়াল ঘরের গোবর-চোনা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট স্থানে বা গর্তে জমা করতে হবে। যা পরবর্তী সময়ে মূল্যবান সারে পরিণত হয়। গরুর গায়ের আঠালি, ডাসা (মাছি), জোঁক অবাঞ্ছিত পোকামাকড় বেছে ফেলতে হবে। গরুর স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে গবাদিপশুকে গোবসন্ত, তরকা, বাদলা, গলাফোলা, ক্ষুরা রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। গবাদিপশুর রোগ দেখা দিলে প্রাণী চিকিৎসক বা নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
গরুর ওজন ১০০ কেজির বেশি হলে প্রতি ৫০ কেজি ওজনের জন্য দানাদার ১ কেজি এবং ঘাস ৫ কেজি যোগ করে হিসাব করতে হবে। যেমন- ১৫০ কেজি ওজনের গরুকে দানাদার ৩ কেজি এবং ঘাস ১৫ কেজি দিতে হবে। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কৃষি খামার গড়ে উঠেছে যেখানে মূলত গরু লালন-পালন করা হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসেবে মতে বাংলাদেশে এখন প্রায় সাত লাখ খামার আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে- কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেক তরুণ পেশা হিসেবে গরুর খামার তৈরি করাকে বেছে নিয়েছে। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ এবং উৎপাদন দুই ক্ষেত্রেই কাঁচা ঘাসের সংকট আছে। এ সংকট মোকাবিলায় আমরা ইউরিয়াকে মোলাসেস ঘাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত পারি। তবে এর পরিমাণ দিনে ৩-৪ কেজির ঊর্ধ্বে হওয়া যাবে না। ৩-৪ কেজির বেশি ইউরিয়া মিশ্রিত খর খাওয়ালে গরুতে ইউরিয়া বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ১০ কেজি শুকনো খড় টুকরো টুকরো করে কাটুন। ৫ লিটার পানি একটি বালতিতে রাখুন; এ ৫ লিটার পানির মধ্যে ২.৫ কেজি চিটাগুড় মিশান, চিটাগুড় মিশ্রিত হলে এর সঙ্গে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া মেশান। এখন ইউরিয়া এবং চিটাগুড় মিশ্রিত পানির দ্রবণটি ১০ কেজি খড়ের সঙ্গে ভালোভাবে মেশান। ব্যাস, ইউরিয়া মোলাসেস তৈরি হয়ে গেল। এখন এ খড় প্রতিদিন প্রতিটি গরুকে ৩ থেকে ৪ কেজি পরিমাণ খাওয়াবেন। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে প্রতিটি গরুকে দিনে ২৫০ গ্রাম সরিষার খৈল খাওয়ালে গরুর ত্বক মসৃণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে চর্বির বৃদ্ধি ঘটে। এ ছাড়া ভাতের মাড়, চাল ধোয়া পানি, সবজির অবশিষ্ট অংশ, ফলমূলের ছোবড়া গবাদিপশুকে খাওয়ান, পশুর বৃদ্ধি খুব দ্রুত হবে।
লেখক ঃ ইমরান সিদ্দিকী
You cannot copy content of this page
Leave a Reply