আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ বৈশি^ক করোনায় কুষ্টিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে করোনা রোগীদের বেড শেষ এখন হাসপাতালের করিডরে নীচে রোগীদের রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। করোনাকালীন কুষ্টিয়ার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সুহৃদ বন্ধু ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। সহযোগি বন্ধু ও প্রতিষ্ঠানকে আমাদের স্বশ্রদ্ধা সালাম জানাই। তারা তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন সেই সাথে নতুনেরা তাদের উত্তরসূরী হয়ে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন এই আমাদের কাম্য। করোনাকালীন যারা সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের উৎসাহ প্রদানে আমরা প্রতিদিন তাদের কথা আন্দোলনের বাজার পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে চাই। আমাদের এই লিখনীর মাধ্যমে আমরাও জেলার করোনাকালীন সময়ে একজন কলম সৈনিক হিসেবে তাদের পাশে থাকতে চাই। সচেতন পাঠক হিসেবে আপনি এই লেখাতে আমাদের তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন।
আজ প্রথম দিনে আমরা কুষ্টিয়ার কয়েকজন করোনাকালীন প্রথম কাতারের করোনা যোদ্ধাদের কথা বলবো। যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে নিজেদের অর্থ ও সময় ব্যয় করে এ কাজটি করে যাচ্ছেন। তারা হচ্ছেন কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেম।
করোনার এই মুহুর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের কাজটি করছেন শহরের কয়েকজন আলেম। গত একবছরের বেশি সময় ধরে আলেমদের এই দলটি প্রায় ৬০টি করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করেছেন। করোনা ভয়ে মৃত ব্যক্তির নিকটজন ও স্বজনেরা কাছে ভিড়ছে না সেখানে এই আলেমদের দলটি নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক পেলেই চলে যাচ্ছেন করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের কাছে। লাশ ধোয়ানো, কাপনের কাপড় পাড়ানো, জানাজা নামাজ আর দাফনের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে ইতিমধ্যে জেলাব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
২০২০সালে মার্চ মাসে করোনার শুরু থেকেই করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে মানুষের মাঝে চরম ভীতি সঞ্চার হয়েছিল। জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় গোসল করানো থেকে শুরু করে লাশ দাফনের ক্ষেত্রে মারাত্বক জীবনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সকলেই পিছপা হয়েছিল।
তখনই কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়া মোমতাজুল উলুম মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতি আরিফুজ্জামান কয়েকজন আলেমকে সাথে নিয়ে একটি টিম গঠন করেন। যাদের কাজ হবে করোনায় মৃতদের বাড়ি বা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গোসল থেকে শুরু করে গোরস্থানে দাফনের মত কাজ গুলো করা। প্রথম দিকে নানান ঝুঁকি ও বাঁধার সম্মুখিন হলেও এখন স্বাচ্ছন্দেই কাজ করতে পারছেন তারা।
মুফতি আরিফুজ্জামান জানান- করোনার প্রথম দিকে করোনা নিয়ে মানুষের মাঝে সাংঘাতিক ভীতি কাজ করছিল। মৃত ব্যক্তির লাশের কাছে কেউ ভয়ে ভিড়তো না আবার লাশ রেখে বাড়ির মানুষজনের পালিয়ে থাকার ঘটনাগুলো আমাদের পীড়া দিত। ঢাকার আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম ও মারকাজুল এশা’র কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদিন আমরা কয়েকজন আলেম ও স্থানীয় যুব সমাজের কয়েকজন বসে এ বিষয়ে আলোচনা করে একটি কমিটি গঠন করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ কাফন পড়ানো ও দাফনের কাজটি আমরা করবো। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে আমাদের এই কাজটি করতে হবে এমন দৃঢ়তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। শুরুটা এত সহজ ছিল না। শুরুতেই এলাকাবাসীর সহযোগিতা পায়নি। পিপি ছিল না। নিজেরা কিনে কাজ শুরু করি। তখন কোন গাড়ি ছিল না।
আমরা লাশ দাফন শেষে মাদ্রাসায় ফিরলে সেখানে এলাকাবাসীর বাঁধার সম্মুখিন হয়। পরবর্তিতে এলাকার কিছু মানুষের সহযোগিতায় আমরা এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পায়। তবে এখন আর সেই বাঁধা নেই। তিনি জানান-আমরা এ পর্যন্ত ৫৮টি মুসলমান আর ২জন হিন্দুর সৎকারের সুযোগ পেয়েছি। খবর পেলেই আমরা নিজেরা গন্তব্যে চলে যায় এবং কাজ গুলো শেষ করে ফিরি। আমাদের এই কাজে পরিবারের মানুষেরা প্রথম থেকেই সহযোগিতা করে আসছে বলে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি জানান-১৫জনের একটি স্বেচ্ছসেবক দল নিয়েই আমাদের কার্যক্রম। ইতিমধ্যে আমাদের এই কার্যক্রমের জন্য যশোরের ‘খেদমতে খলক ফাউন্ডেশন’ একটি মিনি এ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে যা দিয়ে আমরা বিনা মুল্যে করোনায় আক্রান্ত রোগীসহ আরো ১০প্রকারের মানুষের সহযোগিতা করে আসছি। তিনি জানান-সিভিল সার্জন জেলা প্রশাসনসহ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা আমাদের সব সময় সহযোগিতার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান- আমাদের এই দলে রয়েছেন মাওলানা আব্দুল মতিন, হাফেজ শরিফুল ইসলাম, হাফেজ আবুল হাশেম, হাফেজ হাসান আলী, মৌলভি তোফাজ্জুল হোসেন, হাফেজ মাসুম বিল্লাহ, মুফতি আলামীন, হাফেজ মাওলানা কামাল উদ্দিন, হাফেজ মহিববুল্লাহ, রকি আহমেদ, হাফিজুর রহমান সাজু আরো কয়েকজন। এই দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড মাওলানা আব্দুর মতিন জানান- কাজ করতে যেয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে নিকটজনেরা কাছে ভিড়ছেন না আবার ভয়ে অনেকে পালিয়েছেন। জানাজা নামাজেও অনেকে শরীক হচ্ছে না। এটা হৃদয় বিদারক। আমরা হিন্দু ২ ব্যক্তির লাশ নিয়ে সৎকারের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছি কিন্তু দাহ করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি । পরে অনেক বুঝিয়ে তাদের দাহ করার ব্যবস্থা করেছি। গত মাসে ইবি থানার হরিনারায়নপুর এলাকার একজন হিন্দু ব্যবসায়ী করোনায় মারা গেলে আমরা কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে এলাকায় যাওয়ার পথে বাঁধাগ্রস্থ হয়। সেখানে একটি ব্রীজে বাঁশ বেধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এলাকাবাসী। আমরা এ্যাম্বুলেন্স থেকে সেই লাশ কাধে করে কয়েক মাইল দুরে শ্মশানে নিয়ে দাহ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করি। তিনি আরো জানান- আমরা ‘ খেদমতে খলক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১০টি খাতে এ্যাম্বুলেন্স ফ্রি সার্ভিস প্রদান করছি। এর মধ্যে রয়েছে করোনা আক্রান্ত রোগী বা মৃত ব্যক্তি, ওলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসার শিক্ষক, মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী ও ছাত্র সমাজ, মসজিদের ইমাম ও খতিব, মুয়াজ্জিন, মসজিদের খাদেম, এতিম, বিধবা, বেওয়ারিশ ও দুর্ঘটনা কবলিত মানুষেরা। এই সেবা জেলার ৬টি উপজেলায় পাওয়া যাবে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডাঃ আনোয়ারুল ইসলাম জানান-কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেমের করোনাকালীন এই কর্মকান্ড ইতিবাচক। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ও হাসপাতালে যেয়ে লাশ এনে নিঃস্বার্থভাবে দাফনের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন যা প্রশংসনীয়। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ সোনিয়া কাওকাবিন জানান-করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল কিন্তু আলেমদের দল নিজেদের দায়িত্বে এই কাজ গুলো করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন। আমরা সর্বদা তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তাদের পিপি, মাস্ক এমনকি প্রয়োজনে গাড়ি দিয়েও সহযোগিতা করে যাচ্ছি। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদের সৎকারে যাবতীয় সহযোগিতা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।