বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষণা করার পর ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ২০০ শয্যায় রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছে ৩ শতাধিকের কাছে। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় হাসপাতালের উপর কয়েকগুন চাপ বেড়েছে। এদিকে গত ১০ দিনে মারা গেছে শতাধিকের উপর করোনা ও উপসর্গ নিয়ে। মৃত্যু বাড়ায় শহরের তিনটি গোরস্থানে আগের থেকে চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮জনের দাফন করতে হচ্ছে খাদেমদের। আর হাসপাতালের বাইরে বাড়িতে বিপুল সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা বাড়িতেই অক্সিজেনের সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করছেন। এতে অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। দাম বেড়েছে কয়েকগুন। অনেক সময় অতিরিক্ত দামেও মিলছে না অক্সিজেন।
কয়েকদিন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ঘর ঘন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বের হচ্ছে। যেসব অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে প্রবেশ করছে তাতে করোনা রোগী আসছে। আর যেসব অ্যাম্বুলেন্স বের হচ্ছে তাতে লাশ যাচ্ছে। কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে হাসপাতাল এলাকা। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে মারা গেছে ২৪। এখন প্রতি মিনিটে একজন করে মারা যাচ্ছে। তার আগের দিন মারা যায় ১৭জন। এভাবে গত ১০ দিনে মারা গেছে শতাধিকের উপর করোনা ও উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষ। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের হিসেবের বাইরেও জেলায় নানা জায়গায় মানুষ উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। তারা হাসপাতালে আসছেন না। তাদের হিসেব নেই। উপজেলা শহরেও প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে।
অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী মামুন জানান, অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা বেড়েছে। গ্রাম থেকে বেশি কল আসছে। সেখানে পাঠানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। এছাড়া লাশ নিয়ে প্রতি ঘন্টায় যেতে হচ্ছে বাইরে। ঢাকায় রেফার্ড করা রোগী নিয়ে বাইরে যেতে হচ্ছে। তাদের ব্যস্ততাও বেড়েছে আগের তুলনায়। চাহিদা বাড়ায় ভাড়াও বেড়েছে বলে জানান তিনি।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের কর্মি রমজান জানান, এমন রোগীর চাপ আগে দেখেননি। প্রতি ঘন্টায় ৩জনের উপর রোগী ভর্তি হচ্ছে। এমন সময় আছে এক সাথে ১০জন রোগীও আসছে। তখন রোগী টানার ট্রলির অভাব দেখা যায়। রোগী বেশি আসছে অক্সিজেনের স্টোরেও মিনিটে মিনিটে স্লিপ হাতে রোগীর স্বজনরা আসেন সিলিন্ডার নিতে। এখন প্রচুর অক্সিজেন মুজদ রয়েছে। চাপ সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে না। এক সপ্তাহ আগেও সংকট ছিলো।
কুষ্টিয়ার পৌর কবরস্থানের খাদেম মধু মিয়া বলেন, কোন দিন আটটি আবার কোন দিন দশটি। তিনি বলেন, আগে দুই থেকে তিনটি করে কবর খুড়তে হতো। আবার কোন দিন খালি খালি বসে থাকতে থাকতে হতো। এখন কোন বসে থাকা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই ৮-১০টি করে কবর খুড়তে হচ্ছে। শহরের একমাত্র মহাশ্মশানেও বেড়েছে সৎকারের সংখ্যা। এর বাইরে চাঁদাগাড়া ও জুগিয়া গোরস্থানেও দাফন বেড়েছে। এভাবে চললে জায়গা সঙ্কট হতে পারে। আর বর্ষা মৌসুম হওয়ায় কবর খুড়তে বেগ পেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ কবরে পানি উঠে যাচ্ছে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন,‘ হঠাৎ করেই মৃত্যু বেড়েছে। এখন প্রায় প্রতি ঘন্টায় ১ জন মারা যাচ্ছে। কোনদিন কম বেশি থাকছে। তবে এক সপ্তাহ ধরে ১০ এর অধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। বাড়িতে চিকিৎসা নিতে নিতে যখন খারাপা হচ্ছে তখন মানুষ হাসপাতালে আসছে। অক্সিজেনে লেভেল তখন অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, তিনটির বেশি ওয়ার্ডে এখন সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালু করা হয়েছে। প্রচুর সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে। তবে ওষুধ সংকট রয়েছে।’
তবে বাড়িতে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদেরও অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। তারা বাইরে দোকান থেকে কিনে বাড়িতে ব্যবহার করছেন। কোন কোন সেচ্ছাসেবি সংগঠন অনেক সময় ফ্রি সার্ভিসও দিচ্ছেন। তবে জেলা শহরের যে কয়েকটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রির দোকান রয়েছে সেখানে এখন উপচে পড়া ভীড়।
এমন এক দোকান মালিক আক্তারুজ্জামান লাবু বলেন, অক্সিজেনের চাহিদা কয়েকগুন বেড়েছে। মিনিটে মিনিটে ফোন আসে, অক্সিজেনের জন্য। দামও আগের তুলনায় একটু বেড়েছে বলে জানান তিনি।’
হাসপাতালে দায়িত্বরত অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আক্রামুজ্জামান মিন্টু বলেন, ‘গত সাত-আট দিন ধরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে রোগীরা আসছেন। আবার তারা নিজ বাড়িতে ৭-৮দিন আইসোলেশনে থাকার পর আসছেন, যখন অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে যায় তখন। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনা হয় তাদের। ততক্ষণে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। বেশিরভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৮০ নিচে চলে যায়।’
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোমেন বলেন, ‘রোগীর চাপ বাড়ছেই। প্রতিদিন প্রায় ৪০-৫০ নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। করোনামুক্ত হচ্ছেন তার অর্ধেকেরও কম। যার কারণে রোগী ডাম্পিং হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়েছে। গেুলো অন দ্য ওয়ে। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে কুষ্টিয়ার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০০জন। যাদের অধিকাংশের বাড়িই গ্রামে। একই সময়ে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরো ২৯জন।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply