বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাহুল শেখ, ওমর ফারুক, জুয়েল ও বিপ্লবের পেশা আলাদা হলেও তারা ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছুটির দিনে আসলেই মটর সাইকেল নিয়ে ঘোরা তাদের নেশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে শুক্রবার আসলেই বিকেলে দল ধরে বের হয়ে যেত তারা। ঘুরেফিরে রাতে বাড়িতে ফিরত এই কিশোর দল। তবে এবার সখের মটর সাইকেলের বেপরোয়া গতি কেড়ে নিল তিনটি তাজা প্রাণ। হঠাৎ করেই ছন্দপতন তিনটি পরিবারে। প্রিয় সন্তানদের হারিয়ে শোকাতর পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। পরিবারের কেউই মেনে নিতে পারছেন না হঠাৎ এমন চলে যাওয়া। তাইতো নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম। নিহতদের তিনজনকে গতকাল শনিবার সকালে স্ব-স্ব এলাকায় দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাহুল শেখ ও ওমর ফারুকের বাড়ি কুমারগাড়া এলাকায়। আর জুয়েলের বাড়ি বারখাদা এলাকায়। গুরুতর আহত বিপ্লব ও জুয়েল সম্পর্কে খালাতো ভাই। তারা একই গাড়িতে ছিলেন। রাহুল শেখ এর বয়স মাত্র ২৩ বছর। বাড়ি শহরের কুমারগাড়া এলাকায়। তার পিতা মনোয়ার হোসেন শহরের চৌড়হাস কাঁচা বাজারে মাংস ব্যবসায়ী। সকাল ১০টার দিকে মনোয়ার হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তারা বিছানাগত। বাড়ির দোতলায় একটি রুমে রাহুলের মা বিলাপ করছে। স্বজনরা তাকে ঘিরে বসে বাতাস করছেন। আর বারান্দায় বসে কান্না করছেন মনোয়ার হোসেন। রাহুল লেখাপড়া করেছে ক্লাস ৫ পর্যন্ত। সকালে বাবার সাথে ব্যবসা দেখাশোনা করত। মনোয়ার হোসেন বলেন, আমার তাগড়া জোয়ান ছেলে। দেখতে সুর্দশন। বিকেলে ৪টার দিকে মটর সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যায় ফিরবে বলে জানায়। তাদের বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যায়। রাত ৯টায় খবর আসে রাহুল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যায়। গিয়ে দেখি সেখানে নেই। এরপর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি লাশ পড়ে আছে। দুই ভাই একে বোনের মধ্যে রাহুল ছিলেন মেজ। সে টিকটক করত। মটর সাইকেল চালানো ছিল তার নেশা। বন্ধূরা জানান, শুক্রবার হলেই তারা দল বেঁধে ঘুরতে বের হতেন।’ বন্ধুকের প্রত্যেকের দামি বাইক ছিল।’ ওমর ফারুক পেশায় মিস্ত্রি। ফারুকের পিতার নাম শওকত আলী। কুমারগাড়ায় মোড়ে মটর সাইকেল সারার গ্যারেজ আছে তার। রাহুলদের বাড়ি থেকে তার বাড়ি এক কিলোমিটার দুর হবে। তারা এক সাথে মিশতেন। ওমর ফারুকের দোকানে গিয়ে যায় তার বন্ধুরা সেখানে এসেছেন। ১০ থেকে ১৫ জন কিশোর দোকানে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই জানাযা ও দাফন শেষে ফারুকের দোকানে এসে ভীড় করেন। কথা হয় তিনজনের সাথে। তারা বলেন,‘ তাদের বন্ধু সার্কেলে সদস্য আছে ১৫ থেকে ২০জন। নানা পেশায় যুক্ত তারা। শুক্রবার হলে সবাই এক জায়গায় হতেন। মটর সাইকেল নিয়ে এমন দুর্ঘটনায় আগে কেউ পড়েননি। এক সাথে তিন বন্ধুকে হারিয়ে তারা শোকে কাতর। কেউ ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিলেন না।’ কুমারগাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করলেও তাদের আদি বাড়ি সদর উপজেলা কবুরহাটে। সেখানে সকালে ওমর ফারুকের দাফন করা হয়েছে। আর জুয়েল হোসেনের বাড়ি পৌরসভার জুগিয়া এলাকায়। তার বয়স ২০ বছর। গুরুতর আহত বিপ্লব ও জুয়েল সম্পর্কে খালাতো ভাই। জুয়েল মারা গেলেও কোন রকমে বেঁচে যান বিপ্লব। তবে তার অবস্থা গুরুতর। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কলেজ শিক্ষক সেলিম হোসেন বলেন,‘ আমি শহর থেকে নিজের গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম। আলামপুর ব্রীজের ওপর যাওয়ার পর দেখি কয়েকজন কিশোর ও যুবক মটর সাইকেল নিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে আসছেন। আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে তারা চলে যায়। তাদের গাড়ির গতি ১২০ থেকে ১৩০ এর ওপর হবে। আমি বাড়ির পৌঁছানোর আগেই শুনি তারা দুর্ঘটনায় পড়েছে। মারা গেছে তিনজন।’ তিনি বলেন, এমন বেপরোয়া গাড়ি চালানো আমি আগে দেখিনি। তাদের মটর বাইক চালানো দেখে আমাদের ভয় লাগছিল। কুষ্টিয়া চৌড়হাস হাইওয়ে পুলিশের ওসি ইদ্রীস আলী বলেন, ‘আমাদের ফাঁড়ি কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের আলামপুর এলাকায়। আমাদের সামনে দিয়ে রাতের বেলা একদল কিশোর মটর সাইকেল চালিয়ে দ্রুত শহরের দিকে আসছিলো। বিষয়টি আমার নলেজে আসার পর দ্রুত টিমকে জগাদ করে। তারা কিছু আসার পর সেনের চাতাল নামক স্থানে দুই মটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে। খবর পেয়ে সাথে সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি দুইজনের মরদেহ পড়ে আছে। বাকিরা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কাতরাচ্ছিল। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, অতিরিক্ত রেসের কারনেই তারা দুর্ঘটনায় পড়ে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply