বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়া কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু শাখার কর্মকর্তা সোয়েব আল সাবার বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়ম,দুর্নীতি আর লোন দিয়ে অর্থ আদায়ের মত গুরুতর সব অভিযোগ উঠেছে। এক লাখ টাকা লোন পেতে তাকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এ টাকায় ভাগ বসান ম্যানেজার কেএম নাফিজ শাহরিয়ার। ব্যাংকের পেছনে কাঁচাবাজারের মধ্যে চায়ের দোকানে বসেই টাকা ভাগাভাগি করেন সাবা ও তার পোষা দালালরা। নগদ টাকা ছাড়া তিনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ লেনদেন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থ তিনি ব্যাংকে না রেখে বাড়িতে রাখেন। তার অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেওয়ার কথা বলছেন ভুক্তভোগীরা। ডালিম মল্লিক ও রুবিনা খাতুন দম্পত্তি। বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামের চড়পাড়া গ্রামে। পেশায় ক্ষুদ্র কৃষক। পানের বরজ ও পশু পালন করে সংসার চলে তার। কৃষি ব্যাংক কুষ্টিয়া বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখায় ক্ষুদ্র কৃষি লোনের জন্য আবেদন করেন গত বছরের রোজার ঈদের আগে। গরু পালনসহ কৃষি কাজের জন্য এ লোনের জন্য আবেদন করলেও লোন পেতে তাকে ঘুরতে হয় বেশ কয়েক মাস। ২ লাখ টাকা লোনের আবেদন করলেও শেষ পর্যন্ত দেন দরবার করে গত বছরের শেষ দিকে এসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লোন পান। এ টাকা পেতে কৃষি ব্যাংকের মাঠ কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকারও বেশি। ডালিম মল্লিক ও রুবিনা খাতুন দম্পত্তির মত শতশত কৃষক কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জালে বন্দি। দালাল ও টাকা না হলে কোন লোন পাশ হয় না কৃষি ব্যাংকের কোন শাখায়। প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭জন করে দালাল আছে কর্মকর্তাদের। এসব দালালরা লোনের জন্য কৃষকদের সাথে দেন দরবার করে। যাদের লোনের প্রয়োজন নেই এমনকি মাঠে এক কাঠা জমিও নেই তাদের নামে লোন পাশ হচ্ছে অহরহ। কুষ্টিয়া অঞ্চলের সবগুলো কৃষি ব্যাংকের একই চিত্র। বেশ কয়েক সপ্তাহ সরেজমিন মাঠ পর্যায়ে ঘুরে ভুক্তভোগী, দালাল, ইউপি মেম্বার আর চেয়ারম্যানদের সাথে কথা হলে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। কৃষি ব্যাংকের অনিয়ম দুর্নীতি খুঁজতে সদরে তিনটি ইউনিয়নের দুটি ইউনিয়নের প্রায় ৫টি গ্রাম ছাড়াও দৌলতপুর, মিরপুর ও কুমারখালী উপজেলায় খোঁজ নেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে সব থেকে বেশি অনিয়ম হচ্ছে কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মাকের্ট শাখায়। এ শাখা থেকে সদরের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে লোন দেওয়া হয় কৃষকদের। কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানান,‘ মাঠর পর্যায়ে কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জাল পাতা রয়েছে। জমি আছে ও সচ্ছল কৃষকরা আবেদন করলে নানা প্যাঁচ লাগিয়ে দেওয়া হয়। নানা মারপ্যাঁচে ফেলে কৃষকদের কাছ থেকে কর্মকর্তারা টাকা আদায় করেন। প্রতিটি কেসের জন্য টাকা গুনতে হয় কৃষকদের। এ জন্য দালাল নিয়োগ করা আছে প্রতিটি এলাকায়। বিশাল সিন্ডিকেট আছে তাদের।’ কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখার কর্মকর্তা সোয়েব আল সাবা। তিনি আব্দালপুর, আলামপুর ও হরিনারায়নপুর ইউনিয়নের দায়িত্বে আছেন। আব্দালপুরে ইউনিয়নে প্রায় ৩ বছরের ওপরের দায়িত্বে ছিলেন। আর সব মিলিয়ে এখানে প্রায় ৫ বছর এখানে চাকুরি করছেন। তার মাধ্যমে গত কয়েক বছরে এলাকার দুই শতাধিক কৃষক কৃষি লোন নিয়েছে। এর পাশাপাশি সিসি লোনও নিয়েছে অনেক পরিবার। সোয়েব আল সাবার বিরুদ্ধে কৃষক, ইউপি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি লোন পেতে তাকে লাখে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ গুনতে হয়। সাবার নিয়ন্ত্রনে শুধু মাত্র আব্দালপুর ইউনিয়নে দালাল রয়েছে ৫ থেকে ৭জন। এর মধ্যে দেড়িপাড়া গ্রামের হারুন, আব্দালপুরের মানোয়ার, বিষ্ণুদিয়া গ্রামের মাহবুব হোসেন লজেন ও মনিরুল। আব্দালপুরে রুবিনা ও ডালিম মল্লিকের বসতভিটার ওপর বসে কথা হলে বলেন,‘ লোনের আবেদন করার পর অনেক দিন ঘুরতে হয়েছে ব্যাংকে। পরে ২০ হাজার টাকার দাবি করেন সাবা। সেই টাকা লোন পাওয়ার পর শহর থেকে নেন। আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে তারা, তাদের পাতা জালেই কৃষকরা বন্দি। বের হওয়ার কোন উপায় নেই।’ পশ্চিম আব্দালপুর ইউনিয়নের দরগাপাড়া গ্রামের আসাদুল ইসলাম। সচ্ছল কৃষক, ২০১৭ সালে প্রথম কৃষি লোন নেন ২ লাখ টাকা। ২১ সালে এসে পরিশোধ করে নতুন করে লোনের জন্য আবেদন করেন। ৭ একর জমির কাগজপত্র দাখিল করার পর ২ লাখ টাকা লোন নিয়েছেন পুনরায়। এ লোন পেতে সাবাকে ২৪ হাজার টাকা দিতে হয়ে তাকে। কৃষি ব্যাংকের নিচে কাঁচা বাজারের ভেতর থেকে এ টাকা নেন সাবা। গোপালপুর গ্রামের জহুরা খাতুনকে লোন দেওয়ার কথা বলে তার বাড়ির ওপর গিয়ে নগদ ১০ হাজার টাকা নেন সাবা। তবে লোন হয়নি জহুরা খাতুনের। পরে এনজিও থেকে চড়া সুদে লোন নেন তিনি। মধুপুর গ্রামের সিএনজি চালক মহাসিন নামের একজন সাবার মাধ্যমে লোনের আবেদন করেন। দুই লাখ টাকা লোনের জন্য সাবা তার কাছে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ৫৬ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন আব্দালপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বশির উদ্দিন। শহিদুল নামের একজনকেও লোন দিয়ে অর্থ নেন তারা। এছাড়া সপ্না খাতুন, মিজানুর নামের আরও কয়েকজনের কাছ থেকে লোন দিয়ে অর্থ নেন সাবা। বশির উদ্দিন,‘ আমি নিজে কয়েক মাস আগে মহাসিনের লোনের জন্য সাবার কাছে গিয়েছিলাম দুই বার। পরে ৬০ হাজার টাকা দাবি করে শেষ পর্যন্ত ৫৬ হাজার টাকা নেন। এভাবে সাবা গত তিন বছরে এলাকার শতশত কৃষককে লোনের জালে বন্দি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৫ বছরের চাকুরিতে সে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার লিটু হোসেন বলেন, আমার আপন চাচীর কাছ থেকে লোন দেওয়ার নামে সাবা ১০ হাজার টাকা নিয়ে আর লোন দেয়নি। তিনি দালালের মাধ্যমে না গেলে লোন পাশ করেন না।’ বাদশা মিয়া নামের একজন জনপ্রতিনিধি বলেন,‘ শহিদুল ইসলাম নামের এক ইট ভাটা শ্রমিক যার নিজের কোন জমি নেই, অথচ চেয়ারম্যান ও মেম্বারের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে সাবার মাধ্যমে সম্প্রতি দেড় লাখ টাকা লোন নিয়েছে। পরে ধরাও পড়েছে। এ জন্য সাবা তার থেকে ৫০ হাজার নিয়েছে বলে শুনেছি। এ নিয়ে শালিসও হয়েছে।’ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখায় গেলে সোয়েব আল সাবা তেড়ে আসেন। তিনি বলেন, আপনার সাথে কোন কথা বলতে পারব না। কোন তথ্য দিতে পারব না। আপনি তথ্য জানার কে? পরে তিনি বিভিন্ন জনকে দিয়ে তদ্ববির করেন। সাবার কাছ থেকে কমিশন নেন ম্যানেজার কেএম নাফিজ শাহরিয়ার। তিনি সাবার পক্ষে বিভিন্ন জায়গায় তদ্ববির করে বেড়াচ্ছেন। পাশাপাশি সাবা ভুক্তভোগীদের হুমকি দিয়ে ও অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply