সাজ্জাদ রানা ॥ জেলা পর্যায়ে ঢাকার পরই কুষ্টিয়ায় করোনায় মৃত্যু ও সনাক্ত বেশি হচ্ছে। তবে গত কয়েকদিনে আগের তুলনায় সনাক্ত কমেছে। আর মৃত্যু এখনো প্রতিদিন ১০জনের বেশি হচ্ছে। একদিনে ২৪জনও মারা গেছে এ জেলায়। জ্বর-সর্দি, কাশি নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করা, করোনা পরীক্ষা না করোনো ও একবারে শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসার ফলে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অর্ধেক গ্রামের মানুষ। বেশির ভাগের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ ভাগের বেশি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব ধরা পড়েছে। এবার জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গের তীব্রতা কম হলেও একেবারে খেতে না পারা ও শুকনো কাশি থাকছে। এতে করে রোগীরা শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুন মাসের শেষের দিক থেকে জেলায় করোনা সংক্রম উর্দ্ধে উঠতে শুরু করে। আগের সব রেকর্ড ভাঙ্গতে থাকে একের পর এক। এরপর হঠাৎ করে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। করোনা ওয়ার্ডে আগে যে ৩০টি শয্যা ছিলো সেখানে ২০০টি বেড করা হয়। এক পর্যায়ে রোগীর চাপ বাড়তে বাড়তে ৩ শতাধিকে পৌঁছে যায়।
রোগী বাড়ার ফলে শয্যা না থাকায় এখন বারান্দায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে অনেকের। জুলাই মাসের শুরুতেও হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও সিলিন্ডারের সংকট প্রকট ছিলো। মৃত্যু বাড়তে শুরু করায় হাসপাতলের ৪টি ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগ দেয়া হয়। পাশাপাশি সিলিন্ডার সংগ্রহ করা হয়। এর সাথে ১১টি হাইফু¬ ন্যাজাল ক্যানুলার সাথে আরো যোগ হয়েছে ১৩টি। এখন ১৩০টির বেশি বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন রয়েছে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন,‘ অক্সিজেনের কোন সংকট নেই এই মুহুর্তে। তবে শয্যার তুলনায় রোগী বেশি। এ কারনে অন্যান্য সংকট বাড়ছে। তারপরও কাউকে চিকিৎসা বঞ্চিত করা হচ্ছে না। তবে যেসব রোগী গ্রাম থেকে আসছে তাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেক কম থাকছে। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে বাড়িতে থেকে। এসব রোগীকে অক্সিজেন দিয়েও অনেক সময় বাঁচানো যাচ্ছে না। তবে এখন মৃত্যু কমে আসছে। ভর্তি রোগীর ৬০ ভাগেরই উচ্চ মাত্রার অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে।’
কয়েকদিন হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে দেখার গেছে, হাসপাতালের দোতলার পুরোটা অংশ জুড়ে করোনা ওয়ার্ড করা হয়েছে। প্রবেশ মুখেই বারান্দায় দুই পাশে রোগী সারিসারি। প্রত্যেকেরই অক্সিজেন দেয়া লাগছে। স্বজনরা একটু পর পরই স্বেচ্ছাসেবক ও নার্সদের কাছে অক্সিজেন নিতে আসছেন। প্রয়োজন মত অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। হাসপাতালের নিচতলায় একটি বড় রুমে অক্সিজেন রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ট্রলি ভরে অক্সিজেন নিয়ে যাচ্ছেন ওয়ার্ডের আয়ারা।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কুষ্টিয়া সদর উপজেলা রোগী সনাক্ত, মৃত্যু ও নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। সদর উপজেলায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট। এখানকার ইনচার্জ সেলিনা খাতুন বলেন,‘ প্রতিদিন তার কেন্দ্রে কয়েক’শ মানুষের পরীক্ষা হচ্ছে। গ্রাম থেকে বেশি মানুষ আসছে। যারা আসছে তাদের প্রত্যেকের উপসর্গ রয়েছে। অনেক খারাপ অবস্থায়ও আসছে অনেকে।
গত এক সপ্তাহে জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৮ হাজার ৯২৬টি। সনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৭৪ জন। মারা গেছে ৯৯জন রোগী। আর সুস্থ হয়েছে ৮৪৫জন। এই মুহুর্তে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ২৬৬জন।
দেখা গেছে, সদর উপজেলায় মৃত্যু সব থেকে বেশি। জেলায় রবিবার পর্যন্ত যে ৩৪১ জন মারা গেছে এর মধ্যে সদরেরই ১৬০ জন। এর পরই কুমারখলীতে ৫৩জন, দৌলতপুরে ৪২ জন, ভেড়ামারায় ২৮জন, মিরপুরে ৪০জন ও সব থেকে কম খোকসায় ১৮জন। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ১৭০টি নমুনা পরীক্ষায় রোগী সনাক্ত হয় ৯৫জন। সনাক্তের হার ছিলো ৪১.৪৮ শতাংশ। এরপর থেকে রোগী সাক্ত কমতে থাকে। সর্বশেষ গত তিনদিন সনাক্ত ৩০ এর নিচে। গত ২৪ ঘন্টায় সনাক্তের হার ছিলো ২৬ শতাংশ।
হাসপাতালের বারান্দায় থাকা আনিচুর রহমান নামের এক রোগীর স্বজনরা জানান। তাদের বাড়ি মিরপুরে। জ্বর-সর্দি লাগার পর বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গ্রামের হাতুড়ি চিকিৎসকদের চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে আনতে আনতে শ্বাসকষ্ট অনেক বেড়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা যায় ফুসফুসের অবস্থা অনেক খারাপ।
১০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আকলিমা নামের এক রোগীও হাসপাতালে আসে গুরুতর অবস্থায়। বাড়িতে ১০দিন চিকিৎসা নেয়ার পর যখন হাসপাতালে আসে তার হাটার শক্তি নেই। দ্রুত অক্সিজেন দিতে হয়। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ না হলেও অক্সিজেন লেভেল বেড়ে ৯৩ উঠেছে। খেতে পারছে। আগের থেকে অনেক ভালো। তার ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৬০ ভাগ।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মোমেন জানান,‘ হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসছে। প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। শয্যা ফাঁকা থাকছে না। আবার মারাও যাচ্ছে অনেকে। তবে মৃত্যু ধীরে ধীরে কমছে বলে জানান তিনি। আগামী এক সপ্তাহে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।’
এদিকে গত বছর করোনার প্রকোপ শুরু হলে কুষ্টিয়া জেলায় করোনা ওয়ার্ডের জন্য ১৪ চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়। করোনা ওয়ার্ডের জন্য তাদের বিশেষ ভাবে নিযুক্ত করা হয়। বর্তমানে তিনজন মাতৃত্বকালিন ছুটিতে আছেন। আর একজন ঢাকায় পোষ্টিং নিয়েছেন। বাকিরা দায়িত্ব পালন করছেন। এই চিকিৎসকদের বাইরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের চিকিৎকরাও নিয়মিত রোগী দেখছেন। তবে রোস্টারে নাম থাকলেও কিছু চিকিৎসক এক দিনের জন্য করোনা ওয়ার্ডে যাননি বলে জানা গেছে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখনই সবাই নিয়ম মেনে চলবে। সকলে নিয়ম মানলে আল্লাহর রহমতে জেলার পরিস্থিতি আগামী এক সপ্তাহে ভালো হবে আশা করি। তবে গ্রামের মানুষ সচেতন নয়। এ কারনে গ্রামে সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে। তাদেরকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আর উপজেলাগুলোতে করোনার চিকিৎসা যাতে ভালোভাবে মানুষ পাই সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
You cannot copy content of this page
Leave a Reply