নিজ সংবাদ ॥ কুষ্টিয়া চিনিকলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাইচ্যুটি এবং মালামাল সরবরাহকারীর বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও বিধি বহির্ভূতভাবে ৪ কোটি টাকার সঞ্চয় পত্র ভাঙ্গানোর রেজুলেশন করা, নিয়ম ভেঙ্গে পিএফ ফান্ডের সদস্যদের মুনাফার টাকা চিনি ব্যবসায়ীদের প্রদান করা এবং মিলের অবসরপ্রাপ্তদের পিএফ এর অর্থ প্রদানকালে ১৩.৩৩% হারে ঘুষ আদায় সহ ইত্যাদী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কুষ্টিয়া চিনিকলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার মুর্শেদকে বিভাগীয় শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। গত ৩১মে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মোঃ আরিফুর রহমান অপু স্বাক্ষরিত এই আদেশে তাঁর বিরুদ্ধে এই শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। একই সাথে করপোরেশনের চীপ অব পর্সোনেল মোঃ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে গুরুতর অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত মিলের সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চলমান বিভাগীয় মামলাটি বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী দ্রুত নিস্পত্তি করে করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে অবহিত করার জন্য মিলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কুষ্টিয়া চিনিকলের অভিযুক্ত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার মুর্শেদকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে প্রধান কার্যালয়ের প্রধান সিপিই পদে বদলী করা হয়েছিল। পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি বর্তমান পদ থেকে আগামী ২৫ জুন অবসর গ্রহন করবেন। শাস্তিমতে তাঁকে ৩য় গ্রেড থেকে ৪র্থ গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে তিনি অবসরকালীন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কুষ্টিয়ার বৃহত্তর শিল্প প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া চিনিকল দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারনে মিল একেবারেই ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।
উল্লেখ্য ২০২০ সালে অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মিলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার মুর্শেদ শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের (ভবিষ্যত তহবিল) বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতে চিনি বিক্রির লসের টাকা সমন্বয় করতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৪৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে। শুধু তাই নয়, মিলের লোকসান দেখিয়ে শ্রমিকদের মুল বেতন থেকেও টাকা কর্তন করে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। এছাড়া ৬০ টাকা কেজি দরে প্রায় ৩ কোটি টাকার চিনি ফ্রি সেলে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করায় যে ক্ষতি হয়েছে তা সমন্বয় করতে মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের এবং বেতন থেকে টাকা কর্তন করে নিজেরা ভাগ করে নেয়। মিলের বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়-২০১৬ সালে মিলের স্থায়ী শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৫ কোটি টাকা ৫বছর মেয়াদী জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। একই দিনে মৌসুমী শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৫০লক্ষ টাকার একই সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। ২০১৮সালে স্থায়ী শ্রমিকদের ৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্রের মধ্যে এক কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু ১ কোটি টাকার কোন লভ্যাংশ না দিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।
স্থায়ী শ্রমিকদের বাকি ৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র গত বছরের ৪ অক্টোবর ভেঙ্গে ফান্ডে এক কোটি ৫৪লাখ ৮০হাজার লভ্যাংশ পায় মিল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে মৌসুমী শ্রমিকদের ৫০লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রে লাভ পান ১৪ লাখ ৬০হাজার ৬২৫টাকা। মৌসুমীদের টাকা ২০১৯ সালে উত্তোলন করা হয়। সেই টাকা অবসরপ্রাপ্তসহ শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। স্থায়ীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে লভ্যাংশসহ মুল টাকার পরিমাণ ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮০হাজার টাকা। ঐ শ্রমিক-কর্মচারীদের এই টাকা থেকে অবসর প্রাপ্তদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সমুদয় টাকা পরিশোধ ও শ্রমিক কর্মচারীদের ঋণ দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত স্থায়ী ৬৩জন শ্রমিক কর্মচারীর পাওনা ২ কোটি ৮লাখ ৩০হাজার ৪৫৩টাকা আর মৌসুমী অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারী ২৩জনের পাওনা ২২লাখ ১৯হাজার ১৭৭টাকা। এদিকে মিলের চিনি বিক্রির লসের টাকা সমন্বয় করতে সিবিএ নেতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ৪৫ লাখ টাকা উত্তোলনের পরেও শ্রমিক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিলের উপর ১৩.৩৩% টাকা বেআইনীভাবে কর্তন ও শ্রমিকদের বেতন থেকে ১৩.৩৩% হারে টাকা কর্তন করে নিজেরা টাকা ভাগ করে নেয়। কুষ্টিয়া চিনিকলের প্রভিডেন্ট ফান্ড দুর্নীতির সাথে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কয়েকজন সিবিএ নেতার জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত কমিটি। ২০১৫সালের সরকারী গেজেটের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিজস্ব কর্তনকৃত টাকা, ঋণ গ্রহন, ঋণ আদায়, ঋণ গ্রহনের লভ্যাংশসহ হিসাব প্রতিবেদন আকারে প্রত্যেক শ্রমিক ও কর্মচারীকে প্রতিবেদন দেয়ার নিয়ম এবং বার্ষিক কর্তনকৃত টাকা এবং লভ্যাংশের হিসাব নিকাশ প্রতি বছর শেষে পরবর্তি বছরের তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে স্ব-স্ব ব্যক্তিকে লিখিত জানাতে হবে কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ এই গেজেটের কোন নিয়মই মানেনি বরং অবৈধভাবে চাকুরীর থেকে অবসরের কয়েক দিন আগেও পিএফ এর টাকা ঋণ দিয়েছে অনেক কে যা সম্পুর্ন অবৈধ। মিলের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক ও কর্মচারী তার নিজস্ব জমাকৃত অর্থের ৯৫% টাকা ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মিলের সিবিএর অধিকাংশ সদস্যসহ তাদের আত্মীয় স্বজন ও মদদপুষ্ট শ্রমিক ও কর্মচারীরা ২০০% থেকে প্রায় ৬০০% পরিমান টাকা নিয়মবহির্ভুতভাবে ক্ষমতার দাপটে ব্যবস্থাপনাকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ঋণ গ্রহন করেছে। ট্রাষ্টিবোর্ডের নিয়মানুযায়ী ১০ কিস্তিতে তা পরিশোধের বিধান থাকলেও সিবিএ নেতাদের এবং তাদের মদদপুষ্ট শ্রমিক ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। এদিকে একটি সরল হিসেবে দেখা গেছে প্রভিডেন্ট ফান্ডের বর্তমান মুলধন ৫ কোটি ৫৪লাখ ৮০হাজার টাকা। ৫০০টন চিনি বিক্রয়ে যদি ৪০লাখ টাকা লস হয় তাহালে মিলের ৩৬০জন স্থায়ী ও মৌসুমী শ্রমিক ও কর্মচারীর উপর কর্তন করলে সেখানে জনপ্রতি ১হাজার ১১১টাকা হয়। তার পরেও ১৩.৩৩% হারে কেন এত বেশি টাকা কর্তন করে নেয়া হচ্ছে ? সরল হিসেবে আরো দেখা গেছে ৫ কোটি ৫৪লাখ ৮০হাজার টাকার উপর ১৩.৩৩%হারে টাকা কর্তন করলে আদায়কৃত টাকার পরিমান হয় ৭৩লাখ ৯৫হাজার ৪৮৪টাকা। আর ২৩০জন চুক্তিভিত্তিক স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মচারীর তিন মাসের গড় বেতন ৩৯হাজার টাকা হিসেবে ১৩.৩৩% হারে কর্তন করলে সেখানে আরো ১১লাখ ৯৫হাজার ৫৪০টাকা উত্তোলন করা হবে। কুষ্টিয়া চিনিকলের চিনি বিক্রয়ের ৪০লাখ টাকার লস মেটাটে অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে ৯০লাখ ৯১হাজার টাকার বেশি। মিলের পিএফ ফান্ডের টাকা কেলেংকারী বিষয়ে দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশের পর দুদকের একটি দল মিলে অভিযান চালায়। পরে মিলের প্রধান কার্যালয়ের একটি তদন্ত টিম তদন্তে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সিবিএ নেতাদের যোগশাজসে দুর্নীতির চিত্র প্রমানিত হওয়া তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে এবং এমডিকে শাস্তিমুলক বদলী করা হয় প্রধান কার্যালয়ে। পরবর্তিতে আরো তদন্তে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুনীতির অভিযোগ প্রমানিত হয়। এদিকে সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে চলমান বিভাগীয় মামলাটি বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী দ্রুত নিস্পত্তি করে করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে অবহিত করার জন্য মিলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে-কুষ্টিয়া চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান দপ্তরের আদেশ কপি হাতে পেয়েছে খুব শ্রীঘ্রই মিলের দোষী শ্রমিক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানাবে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply