বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নেই কোন পরিবহন ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন হয় না কোন খেলাধুলা। এমনকি ছাত্র সংসদের কার্যক্রমও বন্ধ আছে। অথচ এ তিন খাত থেকেই প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ নেওয়া হয় বিপুল পরিমান অর্থ। এর বাইরেও আছে আরো কয়েকটি খাত। ইচ্ছামত অর্থ আদায় করা হচ্ছে সবার কাছ থেকে। কলেজ সরকারি হলেও বেসরকারি কলেজের মত আদায় করা হচ্ছে নানা খাতে অর্থ।
ছাত্রদের কল্যাণের জন্য নেওয়া এসব টাকায় কল্যাণ হচ্ছে কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের। দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এই তিন খাত থেকে ওঠা কোটি টাকা তাহলে খরচ হয় কোথায় এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকারি কলেজ ঘুরে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, হিসাব বিভাগসহ নানা সুত্রে কথা বলে এসব খাতের অর্থ কোথায় খরচ হয় তা জানান চেষ্টা করা হয়।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ঘুরে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স, মাষ্ট্রার্স ও ডিগ্রী কোর্স মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যায় প্রায় ২১ হাজার। এর মধ্যে ২০টি বিষয়ে অনার্স ও কয়েকটি কম বিষয় নিয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। ভর্তি হওয়ার সময় ছাড়াও প্রতিবার পরীক্ষার আগে ফরম পুরনের সময় বেশ কয়েকটি খাতে অর্থ নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ছাড়াও কলেজ থেকে নেওয়া হচ্ছে পরিবহন ও ছাত্র সংসদ বাবদ অর্থ। এ বাদে আছে আরো অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী ফিস, রোভার-স্কাউট ফিস, দরিদ্র তহবিল ফিস, অভ্যন্তরীন পরীক্ষা ফিস, মসজিদ-ধর্মীয় ফিস, পরিচয়পত্র-রশিদ ফিসসহ বিবিধ ফিস। এর মধ্যে পরিবহন বাবদ প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০ ও ছাত্র সংসদের জন্য ৩৫০ টাকা। দুই খাতে ৪০০ টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত আরো প্রায় ২০০ হাজার বেশি নেওয়া হচ্ছে নানা খাতে। প্রতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী, অনার্স ও মাস্টার্স মিলিয়ে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েন এমন একাধিক শিক্ষার্থী জানান, নতুন ভর্তি হওয়ার সময় তাদের কাছ থেকে পরিবহন ও ছাত্র সংসদের জন্য ৪০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। আবার প্রতিবার পরীক্ষা দেওয়ার আগে পরিবহন ব্যয়ের কথা বলে একই খাতে অর্থ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও আরও অন্য খাতে অর্থ দিতে হয়েছে তাদের। তবে অনেক সময় টাকা দিলেও খাতের বিষয় উল্লেখ করা হয় না। শিওর ক্যাশের মাধ্যমে এখন টাকা জমা দিতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে একই খাতে একাধিকবার অর্থ গুনতে হচ্ছে।
কলেজের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিবহন সুবিধা দিতে মূলত এ অর্থ নেওয়া শুরু হয়। তবে অর্থ নিলেও পরিবহন সুবিধা নেই কলেজে। কলেজের শিক্ষকদের জন্যও কোন পরিবহন কেনা হয়নি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরিবহন ব্যায় বাবদ যে অর্থ নেওয়া হচ্ছে তার সুবিধা তারা পায় না। এ সুবিধা ভোগ করেন বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করা কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা। এ খাত থেকে ওঠা অর্থ তারা টিএ ডিএ হিসেবে নিয়ে থাকে।
কলেজের হিসেবেই প্রতি বছর এ খাত থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ আয় করে কলেজ। বর্তমান অধ্যক্ষ কাজি মনজুর কাদিরের ৪ বছরের বেশি সময়ে এ খাত থেকে কলেজ আয় করেছে ৪০ লাখ টাকার বেশি অর্থ। যার বেশির ভাগ পকেটে ঢুকেছে একটি সিন্ডিকেটের।
কলেজের ছাত্র উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,‘ পরিবহন ব্যয় বলে যে অর্থ নেওয়া হয় তা খরচের তুলনায় তিন থেকে চার গুন। এত অর্থ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডে আসা যাওয়ায় ব্যয় হয় না। শিক্ষার্থীদের ঘাড় মটকে যে অর্থ নেওয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগ কয়েকজনের পকেটে যাচ্ছে। অধ্যক্ষ বিষয়টি জেনেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। সদিচ্ছা থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব।
এদিকে ছাত্র সংসদের জন্য ৩৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। অথচ কলেজে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে ছাত্র সংসদের কোন নির্বাচন হয় না ও কোন কমিটি নেই। ছাত্র সংসদের জন্য নেওয়া অর্থের মধ্যে ম্যাগাজিন, খেলাধুলা, ভ্রমনসহ নানা অর্থ ভাগ করা রয়েছে। ছাত্র সংসদ বাবদ প্রতি বছর প্রায় ২৩ থেকে ২৪ লাখ টাকার কাছে প্রায় হয়। বর্তমান অধ্যক্ষের সময়ে শুধুমাত্র এ খাত থেকে কলেজ পেয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি।
মাস্টার্সের একজন ছাত্র বলেন, ফরম পুরনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বাবদ নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। আর কলেজ নানা খাতে নিয়েছে ২ হাজার ৬৯৫ টাকা। প্রায় সমপরিমান টাকা কলেজ নিয়ে নিচ্ছে। যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা। সরকারি কলেজ হলেও নানা খাতে টাকা নেওয়ার নামে জুলুম করা হয়। গরীব ছাত্ররাও রেহায় পায় না।
অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারীদের নামে যে অর্থ তোলা হয় সেটাও বড় অংকের। ১০০জনের ওপর কর্মচারী আছে যারা অস্থায়ীভাবে চাকুরি করেন। কলেজ তাদের নিয়োগ দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক তদ্ববির ও কর্মকর্তাদের স্বজনদের অনেকে চাকুরি করেন যারা ডিউটি না করেই বেতন নেন। ২০ থেকে ৩০জন কর্মচারীর অতিরিক্ত অর্থ টানছে কলেজ। বিষয়টি স্বীকারও করেন কলেজের একজন শিক্ষক নেতা।
অনার্স ও মাস্টার্স শাখার ২জন মেয়ে ও দুই জন ছেলে শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়। তারা বলেন,‘ কলেজে ভর্তির পর অর্নাসের শিক্ষার্থীরা কোন খেলাধুলা দেখতে পাইনি। মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে খেলার বিষয়ে জানে। একই সময় কলেজ থেকে কোন ভ্রমন, সাংস্কৃতিক প্রয়োগিতা হয়নি। শুধু মাত্র জাতীয় দিবসগুলো পালন হয়েছে।
শরীর চর্চার শিক্ষক আখতার মাহমুদ সাগর বলেন,‘ ২০১৮ সালে সর্বশেষ খেলাধুলা হয়েছিলো। তার আগের খবর আমি বলতে পারি না। আমি নিয়োগ পেয়েছি ২০১৭ সালে। আমি চেষ্টা করি খেলাধুলা আয়োজনের জন্য। তবে মাঠে সমস্যা থাকায় নিয়মিত হয়নি। এখন মাঠ ঠিক করা হচ্ছে, নিয়মিত হবে খেলাধুলা।’
তাসনীম ও ফায়াজ নামের দ্ইু শিক্ষার্থী বলেন,‘ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নামে অর্থ নিলেও কলেজে এসব হয় না। কলেজের একমাত্র মাঠটি দখল হয়ে যাচ্ছে। পানিতে ডুবেছিলো তিন থেকে ৪ বছর ধরে। সেখানে এখন মাটি ফেলা হচ্ছে। মাঠের সামনে দোকানসহ রাজনৈতিক দলের অফিস। এসব নিয়ে স্যারদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। কোটি কোটি টাকা পরিবহন ও ছাত্র সংসদের নামে তুলছেন স্যাররা। এসব টাকা যায় কোথায় আমরা জানি না।
জানা গেছে, যে অর্থ শিক্ষার্থীদের কল্যানের জন্য নেওয়া হয় তা দিয়ে তাদের কোন কল্যাণ হচ্ছে না। প্রতি বছর জাতীয় দিবস ছাড়াও কলেজের আয়োজনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিক্ষাথীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ এখানে ব্যায় করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে ভাউচার করে বিল তোলা হয়। তবে কত বিল তোলা হয় তা জানেন একমাত্র অধ্যক্ষ। সোনালী ব্যাংক বাবর আলী গেট শাখায় কলেজের হিসাব থেকে এ অর্থ তোলা হয়। অনুষ্ঠান কমিটির একজন শিক্ষক বলেন,‘ ৫০ হাজার টাকার কমে কোন অনুষ্ঠান হয় না, তবে বিল ওঠে তার কয়েকগুন বেশি।
বর্তমান অধ্যক্ষ কাজী মনজুর কাদির যোগদান করেছেন প্রায় ৪ বছরের বেশি সময়। তিনি ভাউচার করে অনুষ্ঠানের নামে অর্থ তোলেন পাশাপাশি পরিবহনের জন্য নেওয়া অর্থ যায় তার দপ্তরে। প্রতিবছর দুই ঈদ ছাড়াও উৎসবগুলোতে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা ভাগ পান এ অর্থ থেকে।
ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট শামীম উল হাসান অপু বলেন,‘ ছাত্র সংসদ না থাকায় এ খাতে নেওয়া অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যায় হয় সে বিষয়ে কোন জবাবদিহিতা নেই।
আমাদের সময় সারা বছর খেলাধুলা ছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা হতো। যেসব খাতে অর্থ নেওয়া হয় তা দিয়ে যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে না হয় তাহলে এসব অর্থ নেওয়ার দরকার কি।’
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী মনজুর কাদির বলেন,‘ পরিবহনের জন্য যে অর্থ নেওয়া হয় তা শির্ক্ষাথীদের কল্যানে ব্যয় হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বোর্ডে আসা যাওয়া ব্যক্তি ও প্রশ্ন নিয়ে আসা গাড়ির ভাড়া দেওয়া হয় এ খাত থেকে। আর ছাত্র সংসদের অর্থ থেকে জাতীয় সব দিবসের খরচ করা হয়। মাঠে সমস্যা ছিলো, সেটা সমাধান করার পর খেলাধুলা হবে নিয়মিত, মেয়েদের জন্য আলাদা মাঠের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অর্থ ব্যয় করা হয় সচ্ছতার সাথে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঠিক মত না আসায়, শিক্ষকরা নিরূপায়।’
Leave a Reply