কৃষি প্রতিবেদক ॥ দেশের প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে জায়ান্ট মিলিবাগ নামক এক ধরনের ধীরগতিসম্পন্ন পোকা, যা বিভিন্ন গাছপালা থেকে রস চুষে খায়। মিলিবাগ আম, কাঁঠাল, পেঁপে, লিচু, কলা, পেয়ারা, লেবু, বেগুন, শসা, টমেটো, বাঁধাকপি ও রেইনট্রিসহ অন্যান্য প্রায় সব ধরনের গাছকে আক্রমণ করে। এর আক্রমণে গাছের ফলন কমে যাওয়ার পাশাপাশি গাছ মারাও যেতে পারে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদরা জানান, ‘জায়ান্ট মিলিবাগ সাদা রংয়ের ছোট পোকা। পোকাটির দেহ ডিম্বাকৃতি ও চ্যাপ্টা। আকারে প্রায় ১ সেন্টিমিটার লম্বা, মাংসল দেহ, দেহের চারদিকে পাউডারের মতো মোম-জাতীয় পদার্থ থাকে। গায়ের রং ধূসর সাদা, স্ত্রী পোকার পাখা নেই, এটি হেঁটে চলাফেরা করে, পুরুষ পোকা দেখতে কিছুটা লালচে এবং পাখাযুক্ত। এটি উড়তে পারে। পোকাটি সাধারণত ভারত উপমহাদেশসহ অন্যান্য উষ্মমন্ডলীয় দেশে পাওয়া যায়।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘জায়ান্ট মিলিবাগের জীবনচক্রে তিনটি পর্যায় বিদ্যমান। ডিম, নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ পোকা। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম ফুটে বাচ্চা বা নিম্ফ বের হয়। পরে পোষক গাছকে আক্রমণ করে। কচি কান্ড, পাতা, ফুলের কুঁড়ি, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায় এবং বড় হতে থাকে। তিনবার খোলস বদলায় এবং পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকার পাখা নেই, এর গায়ে সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
পুরুষ পোকা লাল বর্ণের এবং এর দুই জোড়া কালো পাখা আছে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ার জন্য গাছ থেকে মাটিতে নেমে আসে। আবর্জনার নিচে মাটির মধ্যে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার সময় তারা এক ধরনের সাদা তুলার মতো থলি তৈরি করে। তার ভেতর ডিম পাড়ে। প্রতিটি থলিতে ২০০-৬০০টি পর্যন্ত ডিম থাকে। ডিম পাড়ার পর স্ত্রী পোকাটি মারা যায়। ডিম তাৎক্ষণিকভাবে না ফুটে মাটির নিচেই পরবর্তী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকে।’
এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘এটি তার জীবনচক্রের নিম্ফ অবস্থায় গাছের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। নিম্ফ এবং পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা গাছের বিভিন্ন অংশ যেমনÑকচি কান্ড, পাতা, পুষ্পমঞ্জরী, ফুলের কুঁড়ি, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত পুষ্পমঞ্জরী, ফুলের কুড়ি, ফুল ও ফল ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত গাছে ফলের পরিমাণ কমে যায়। বেশি আক্রান্ত হলে গাছ ফলশূন্য হয়ে পড়ে। দুর্বল হয়ে ধীরে ধীরে মারা যেতে পারে। এছাড়াও এর দেহ থেকে এক ধরনের রস ক্ষরণ হয়, যাকে মধুরস বলে। ক্ষরিত মধুরস পাতায় জমা হয়ে স্তর সৃষ্টি করে, যেখানে সুটি মোল্ড নামক ছত্রাক আক্রমণ করে। ফলে পাতার রং কালো হয়ে যায়। এতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে, খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়।’ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘গাছের গোড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মে-জুন মাসে গাছের গোড়ার আবর্জনা ও মাটি সরিয়ে ডিমগুলা ধ্বংস করতে হবে। নিম্ফ যেন গাছে উঠতে না পারে সেজন্য আঠালো ব্যান্ড/পলিথিন ও গ্রিজ গাছের কান্ডের চারপাশে মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে পেঁচিয়ে দিতে হবে। পূর্ণ বয়স্ক পোকা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য গাছের চারদিকে নালা তৈরি করে কেরোসিন মিশ্রিত পানি দিয়ে রাখতে হবে।
পোকার আক্রমণ দমন করতে তিনি বলেন, পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী পোকা ঝাড়ু দিয়ে একত্রিত করে আগুন দ্বারা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নিম্ফ অবস্থায় জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি মাসে অনুমাদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করে এ পাকা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’ তবে এটি মানুষের কোনো ক্ষতি করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি মানুষকে আক্রমণ করে না বা স্বাস্থের ক্ষতি করে না। তবে শরীরে লাগলে চুলকানির কারণ হতে পারে।’
এই গবেষক আরও জানান, জায়ান্ট মিলিবাগ একটি বিদেশি পোকা। বিদেশ থেকে বিভিন্ন গাছপালা নিয়ে আসার সময় এ পোকা দেশে ঢুকে পড়ে। যে অঞ্চলের পোকা, সে অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। মিলিবাগ যেহেতু বিদেশি পোকা তাই আমাদের দেশে এর প্রাকৃতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ফলে অবাধে বংশবিস্তার হচ্ছে। এটি বাংলাদেশে প্রথম ২০০৩ সালে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দেখা যায়। একই বছর রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যায়।’
You cannot copy content of this page
Leave a Reply