নিজ সংবাদ ॥ আসমার সাথে অন্য কোন পুরুষের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি সৌমেন। তাই ক্ষোভ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করা আসমা খাতুন ও শাকিলকে। তবে শিশু রবিনকে হত্যা করে অনুতপ্ত সৌমেন। নিষ্পাপ রবিনকে হত্যা করার কোন ইচ্ছে তার ছিল না। পরিস্থিতিতে পড়ে কিভাবে রবিনকে হত্যা করেছেন তা বুঝে উঠতে পারেননি। হঠাৎ করেই তার মাথা বিগুড়ে ওঠে। আর আগে থেকে নানা ক্ষোভ থাকায় মুহুর্তে গুলির ঘটনা ঘটে যায়। কুষ্টিয়ার আদালতে বিচারকের সামনে দেয়া জবানবন্দিতে সৌমেন এসব কথা বলেছেন।
তিন খুনের ঘটনার অভিযোগে গ্রেপ্তার পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত এএসআই সৌমেন কুমার রায়কে আদালতে তোলা হয়। গতকাল সোমবার দুপুর সোয়া ১টায় কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রেজাউল হকের আদালতে তোলা হয় তাকে। বিচারকের খাস কামরায় শুনানি শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন সৌমেন। তার জবানবন্দি রেকর্র্ড করেন বিচারক। এরপর তা লিপিবদ্ধ করা হয়।
আদালতের একটি সূত্র জানিয়েছে, খুলনা থেকে মূলত আসেন আসমাকে নিয়ে যেতে। কুমারখালীর বাগুলাট ইউনিয়নের নাতুড়িয়া নানা বাড়ি অবস্থান করা আসমা রোববার তার শিশু পুত্র রবিনকে সাথে নিয়ে শহরের বাসায় আসেন। বাসায় যান সৌমেনও। মালামাল গুছিয়ে তারা রওনা দেয়ার জন্য বের হলে আসমা পথের মধ্যে যাবে না বলে বাগড়া দেয়। এ সময় কয়েকবার কথাকাটি হয়। পরে শাকিলের সাথে যোগাযোগ করে এক সাথে যায় কাস্টমস মোড়ে। সেখানে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে গুলি করে হত্যা করেন স্ত্রী দাবী করা আসমা, শাকিল ও শিশু রবিনকে। প্রথমে কাউকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না বলে জানায় সে। পরিস্থিতিতে পড়ে সে হত্যা করে আসমা ও শাকিলকে। তবে রবিনকে মারার তার কোন ইচ্ছে ছিল না। রবিন নিষ্পাপ তার কোন দোষ ছিল না, তাকে মেরে আমি অনুতপ্ত বলে আদালতের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন।
কুষ্টিয়া মডেল থানায় যে মামলা হয়েছে তাতে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে থানার ইন্সপেক্টর নিশি কান্তকে। তিনি আদালতে সাংবাদিকদের বলেন,‘ মামলার আসামী সৌমেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সে একাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিস্তারিত বলেছে আদালতে। জবানবন্দি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
একাধিক সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগদান করেন সৌমেন কুমার রায়। তখন বাগুলাটে নানী বাড়ী থাকতেন আসমা। কোন একটি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আসমা থানায় যান। সেখানেই সৌমেনের সাথে তার পরিচয় হয়। সৌমেনও মামলার তদন্ত করতে অফিসারের সাথে একাধিক দিন বাগুলাট আসমার নানা বাড়ী যান। এভাবে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এর মাঝে তারা বিয়ে করেন।
কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে কর্মরত একজন কর্মকর্তা বলেন,‘সৌমেন কুমারখালী, মিরপুর ও ইবি থানায় চাকুরি করেছেন। মিরপুরে চাকুরি করার সময় নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। সে পরনারীতে আসক্ত ছিলো। তার বিরুদ্ধে স্থাণীয় কয়েকটি পত্রিকায় অনিয়মের সংবাদ ছাপা হওয়ার পর তাকে এ জেলা থেকে বদলি করে দেয়া হয়।
আসমার মা হাসিনার সাথে কথা হলে জানান,‘ শহরের বাবর আলী গেটে আমাদের বাসা। এ বাসায় মাঝে মধ্যে আসতো আসমা। রবিনও তার সাথে থাকতো। পরে তারা আলাদা আরকেটি বাসা ভাড়া নেয়। সৌমেনকে বিয়ে করার বিষয়টি আমরা জানতাম। এর আগেও তার মেয়ে আসমার কয়েকবার বিয়ে হয়েছিল। আসমার বাবার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মূলত দুরত্ব তৈরি হয়। এরপর আসমা আমার মায়ের বাড়ি বাগুলাটে গিয়ে থাকতো মাঝে মধ্যে। সে নানী বাড়িতে একটি ঘরও করছে। রোববার সকালে সেখান থেকেই শহরে আসে। খুলনা যাওয়ার বিষয়টি আমাদের কারো জানা ছিল না। মেয়ের আচরন ও চলাফেরা নিয়ে আমরাও সন্তুষ্ট ছিলাম না। তারপরও মেনে নিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, সৌমেনের সাথে বিয়ে হলেও খুলনা যাওয়ার পর তাদের দেখা সাক্ষাত হতো মাঝে মধ্যে। কুষ্টিয়া থাকাকালীন তারা এক সাথে থাকতো। খুলনায় যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে সে আসতো। তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। তারপরও তাকে এমনভাবে হত্যা করা হয়েছে মেনে নিতে পারছি না। আমার নাতিটার তো দোষ ছিলো না। তাকে অনেক কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে। এর বিচার চাই আমরা।
হাসিনা কুষ্টিয়া শহরের পৌর বাজারের রেল লাইনের ধারে ডিম ও সবজি বিক্রি করেন। বাগুলাট ইউনিয়নের নাতুড়িয়া গ্রামে আসমার নানী বাড়ি এলাকার এক মেম্বার জানান,‘ আসমা মাঝে মধ্যেই এখানে এসে থাকতো। তার বাড়িতে প্রায়ই বাইরের লোকজন আসতো। এ নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলতো। সম্প্রতি নানী বাড়িতে পাকা দালান করছে আসমা। সৌমেনের সাথে তার সম্পর্কের কথা এলাকার অনেকেই জানতো। এলাকার মানুষের সাথে তাদের তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না।
আসমার প্রথম পক্ষে একজন মেয়ে থাকলেও তার সাথে যোগাযোগ ছিল না। রবিনকে সাথে রাখতো সে। আসমার সব বিষয় জেনেও সৌমেন তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। আসমাকে বিয়ে দাবি করলেও বিষয়টি নিয়ে ধুম্রজাল রয়েছে। মুসলিম থেকে সনাতন ধর্মে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আসমার পরিবারের দ্বিমত রয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আসমা একাধিক বিয়ে করলেও সে বিভিন্ন সময় লোকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। লোকজনকে ব্লাকমেইলিং করে অর্থ আদায় করতো। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতো সৌমেন। সর্বশেষ শাকিলের সাথে তার সম্পর্ক বজায় ছিলো। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে সৌমেনের সাথে আসমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। এরই জের ধরে শাকিলের বাড়িতে গিয়ে সে হুমকি দিয়ে আসে। তারপরও আসমা শাকিলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো। সৌমেন খুলনায় থাকার সুবাদে আসমা অবাধে চলাচলা ফেরা করতো। সর্বশেষ সে কারো সাথেই আর সম্পর্ক রাখতে রাজী ছিল না। সৌমেনের সাথেও সে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চাইছিলো, কিন্তু সৌমেন আসমাকে কোন ভাবেই ছাড়তে চাইছিলো না। এ থেকে বিরোধ জোরদার হয়।’
সৌমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,‘ কুষ্টিয়াতে সৌমেন চাকুরি করায় এ জেলায় তার বেশ কিছু পরিচিত ও কাছের লোকজন রয়েছে। শাকিলের সাথে আসমার সম্পর্ক যে চলছিলো সে খবর লোকজনের মাধ্যমে পেয়ে যেত। তাই আসমাকে কুষ্টিয়াতে আর রাখার পক্ষে ছিলো না সে। তাই খুলনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে রোববার। আগে থেকেই যোগাযোগ হয় তাদের।
সৌমেন আসমাকে নিয়ে বিকেলের আগে খুলনায় ফিরে যেতে পারবে ভেবেছিলো। এ কারনে ওয়ারেন্ট তামিলের কথা বলে কুষ্টিয়ায় আসে। সরকারি অস্ত্র ও গুলি এ জন্য সে নিজের কাছে রেখেছিলো। তিনজনকে হত্যার পর পাবলিক তাকে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা ছিলো। তাই পাবলিক লক্ষ্য করেও গুলি চালায় সে। তবে করো গায়ে লাগেনি সে গুলি। তবে রবিনকে মেরে সে অনুতপ্ত।’
নৈতিক অবক্ষয় থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে সে। এজন্য দায়ভার সব তার। তবে এতে পুলিশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে নিহতদের মরদেহ সকালে স্বজনরা হাসপাতাল থেকে বুঝে নেন। এর আগে রোববার সন্ধ্যার আগে তাদের পোষ্ট মোর্টম করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন,‘ আসমা, শাকিল ও রবিনের দুটি করে গুলি লাগে। প্রত্যেকের মাথায় গুলির লাগার প্রমাণ মিলেছে। রবিনের একটি গুলি পেছন থেকে মাথায় বিদ্ধ হয়। আর অন্যদের সামনে থেকে গুলি চালানো হয় মাথায়। সবগুলি বের হয়ে যায়।
আসমা ও রবিনের মরদেহ দাফন করা হয়েছে তার বাবার বাড়ি যদুবয়রা ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামে। আর শাকিলের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা গ্রামে দাফন করা হয়।
শাকিলের মা নুরজাহান ও বাবা মেজবার জানান, তার ছেলে তো নিরীহ। তার কোন দোষ ছিলো না। ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকুরি করে সংসার চালাতো। তার মৃত্যু আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এ হত্যা পরিকল্পতি বলে দাবি করেন তারা। কারণ এর আগেও আমাদের বাড়ির ওপর এসে সৌমেন শাসিয়ে যায়। এরপর সে আমাদের ছেলেকে গুলি করে মারলো। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই আমরা। শাকিলকে হারিয়ে তার স্বজনরা বাকরুদ্ধ। একেবারে দরিদ্র ঘরে সন্তান শাকিল। তাইতো সংসার চালাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিকাশে চাকুরি নেয়।
শাকিলের পরিবারের লোকজন জানান, আসমার সাথে তার কিভাবে পরিচয় আমরা জানতাম না। আমাদের বাড়িতেও আসমা এসেছে। ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিলো তাদের মধ্যে। কয়েক মাস আগে সৌমেন এসে হুমকি দিয়ে যায়। শাকিলকেও আমরা নিষেধ করে দিই। তারপরও এমন ঘটনা ঘটে গেল তা আমরা ভাবতেও পারছি না। দেখতে সুদর্শন শাকিলকে এলাকার মানুষ খুব ভালো বলে জানে। তারাও এটা মেতে নিতে পারছে না। শাকিলের দাফনে এলাকার মানুষ ও স্বজনরা অংশ নেন। কুষ্টিয়া কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলো। তারা তিন ভাই বোন।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম বলেন, থানায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামী সৌমেনকে আদালতে তোলা হয়। সে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবাববন্দি দিয়েছে। মামলাটি তদন্ত শুরু হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতে চার্জশীট দেয়া হবে। জবানবন্দি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলায় বাদী ন্যায় বিচার পাবে বলে আমরা আশা করছি। পুলিশ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।’
You cannot copy content of this page
Leave a Reply