কৃষি প্রতিবেদক ॥ শীতকালের ফুলের মধ্যে গাঁদা অন্যতম। বিবাহ, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, গৃহসজ্জা, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও শহীদ দিবসসহ সব অনুষ্ঠানেই গাঁদা ফুলের বিকল্প নেই। কেটে যাওয়া ত্বকের রক্ত পড়া বন্ধ করতে, কাটা ঘা শুকাতে ও জীবাণুনাশক হিসেবে গাঁদা পাতার রস খুব উপকারী। গাঁদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ফুল। এটি একটি শীতকালীন ফুল। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রঙের হয়। বাগানের শোভা বর্ধন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে এ ফুলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। শীতকালে এই ফুল বেশি ফোটে। বাংলাদেশের প্রায় জেলাতেই এই ফুলের চাষ করা যায়। গাঁদা ফুল গোলাপি ও লাল রংয়ের হয়ে থাকে। গাঁদা ফুল গাছের পাতার রসও গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন চর্মরোগের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। কাটাস্থানে গাঁদা ফুল গাছের রস লাগালে ক্ষত স্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। গ্রামে-গঞ্জে এখনো এটি ক্ষতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গাঁদা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ফুল। সাধারণত এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে এটি গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালেও চাষাবাদ হয়ে থাকে। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রংয়ের দেখা যায়। বাগানের শোভাবর্ধন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বন ও গৃহসজ্জায় এর ব্যাপক ব্যবহার ফুলটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। ক্ষত ও আঘাতে এর পাতার রস অত্যন্ত কার্যকরী। পাতার রস কান পাকা রোগ ছাড়াও ছত্রাকনাশক হিসেবে বেশ কার্যকরী। গাঁদা ফুলের নির্যাস টিউমারের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। গাঁদা ফুলের নির্যাস ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জমিতে গাঁদা গাছের শুকনা গুড়া বা অপ্রয়োজনীয় অংশ প্রয়োগ করে নেমাটোডের মতো মারাত্মক রোগের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের তেল ও সুগন্ধী তৈরিতে গাঁদা ফুল ব্যবহৃত হয়। যেসব এলাকায় গাঁদা বেশি পরিমাণে চাষ হয়- যশোরের গদখালী, ঝিকরগাছা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর জেলার সদর উপজেলা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও পটিয়া, ঢাকা জেলার সাভার এলাকায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে গাঁদা ফুলের চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশে সাদা গাঁদা, জাম্বো গাঁদা এবং রক্ত বা চাইনিজ গাঁদার চাষ হয়ে থাকে। গাঁদা গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটা প্রধানত দিনের দৈর্ঘ্য ও তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। পরিমাণমতো মাটির রস ও পুষ্টি উপাদানও গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটার জন্য প্রয়োজন। দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হলে এবং স্বল্প তাপমাত্রায় আফ্রিকান গাঁদা ভালোভাবে ফোটে এবং এর জীবনকালও বেশি হয়। এটেল দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী, তবে যতœসহ চাষ করলে যে কোন ধরনের মাটিতেই চাষ করা যেতে পারে। পানি জমে না এমন উর্বর অ¤¬ (পি এইচ ৭.০ হতে ৭.৫) মাটি গাঁদা চাষের জন্য ভালো। ফরাসি গাঁদা খুবই নিকৃষ্ট মাটিতে ভালো হলেও আফ্রিকান গাঁদা চাষের জন্য পর্যাপ্ত সার দিতে হবে। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে এবং জমিতে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাঁদা চাষের জন্য মৃদু আবহাওয়া প্রয়োজন। গাঁদা ফুলের বংশ বিস্তার বীজ বা কাটিংয়ের মাধ্যমে করা যায়। বীজ থেকে যে গাছ হয় তা স্বাস্থ্যবান, লম্বা ও অধিক ফলনশীল হয় বলে সাধারণত বীজের মাধ্যমেই বংশ বিস্তার করা হয়। তবে জাতের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে হলে অবশ্যই কাটিং বা অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তারই সহজ ও ভালো। বীজের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলার মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বীজতলায় নিয়মিত পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে বীজতলায় যেন পানি জমে না থাকে। চারাগুলো ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি লম্বা হলে আগা কেটে দিলে চারা অতিরিক্ত লম্বা হয় না এবং সবল থাকে। এক মাস বয়স হলে চারাগুলো মূল জমিতে রোপণ করা যাবে। এ ছাড়া ফুল দেওয়া শেষ হলে সবল ও সুস্থ গাছ নির্বাচন করে তা থেকে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা ডাল কেটে নিতে হবে। কাটিংগুলো পরে ছায়াযুক্ত স্থানে বালি ও মাটির মিশ্রণ ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করতে হবে এবং নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। এতে কাটিংয়ে খুব তাড়াতাড়ি শিকড় গজাবে। পরে গাছগুলো টবে বা জমিতে লাগাতে হবে। কাটিং বা বীজ থেকে প্রাপ্ত চারা বর্ষার শেষে মূল জমিতে বা টবে রোপণ করতে হবে। ৩ থেকে ৪ পাতা বিশিষ্ট সবল চারা রোপণের জন্য ভালো। বিকালে যখন রোদের তাপ কমে যাবে তখন জমিতে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২ হাত এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৬ ইঞ্চি। চারাগুলো লাগানোর আগে পাত্রে পানি নিয়ে দুই চা চামচ ডায়াথেন- এম ৪৫ ওষুধ মিশিয়ে চারাগুলো ওই পানিতে ভিজিয়ে ৫ থেকে ৬ মিনিট পর তুলে লাগালে চারার মৃত্যুহার অনেক কম হবে। গাঁদা ফুল সারা বছরে তিনবার উৎপাদন করা যায়। চারা রোপণের ৩০ থেকে ৪৫ দিন পর একরপ্রতি ৭০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর ৮ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কোনো কিছু করতে হবে না। জমিতে বা বীজতলায় চারা লাগানোর পর আগাছা বেশি হয়, গাঁদা ফুলের জমিতে নিড়ানি দিয়ে জমি কুপিয়ে দিতে হবে, তারপর প্রতি একরে ৬০ কেজি হারে ডিএমপি সার শুধু গাছের সারির মধ্যে ছিটিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার পর যে চারাগুলো মারা যাবে, সেই জায়গায় অন্য জায়গা থেকে চারা এনে পূরণ করতে হবে। চারা যখন বড় হবে তখন গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হবে। গাঁদার জন্য অপেক্ষাকৃত কম সেচের প্রয়োজন, তবে ফুল আসার পর সেচ দিলে ফুল বড় হয় এবং ফুলের রং ভালো হয়। জমিতে সেচ সাধারণত খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যার আগে দিতে হবে, প্রচন্ড রোদে জমিতে সেচ দেওয়া যাবে না; কারণ এতে চারার ক্ষতি হয়। গাছে বেশি ফুল পেতে চাইলে ‘স্টপিং পদ্ধতিতে’ গাছের ডগা কেটে দিতে হবে। এতে গাছে ডালপালা ও বেশি ফুল হবে। চাইনিজ, রাজগাঁদা, আফ্রিকান ও ফরাসি জাতের গাঁদা আমাদের দেশে বেশি চাষ হয়। রং ভেদে গাঁদার জাত হচ্ছে হলুদ, লাল, কমলা, গাঢ় খয়েরি, লাল হলুদের মিশ্রণ ইত্যাদি। আফ্রিকান জাতের গাছ সোজা ও লম্বা, ৩০-১০০ সেমি লম্বা হয়। ফুল- কমলা, হলুদ ও গাঢ় খয়েরি রংয়ের ছিটা দাগযুক্ত হয়। ফরাসি গাঁদার গাছ খাট ও ঝোপালো, ১৫-৩০ সেমি লম্বা হয়। ফুল আকারে ছোট, প্রচুর ধরে ও রং লাল। কমলা সুন্দরীর গাছ খুব শক্ত। ফুল গাঢ় কমলা। শাখা প্রশাখা বেশি হওয়ায় ফুল বেশি ধরে। ফুলের আকার ৪.৫ থেকে ৫ সেমি। অনেক দিন পর্যন্ত। প্রতি গাছে ৫৫-৬০টি ফুল পাওয়া যায়। রোগ সহনশীল। শাখা কলম ও বীজের মাধ্যমে গাঁদা ফুলের চারা তৈরি করা যায়। নভেম্বরে বীজতলায় বীজবপন করে চারা উৎপাদন করতে হয়। সারা বছর চাষ করা গেলেও শীতকালে ফলন ভালো হয়। শাখা দিয়ে কলম করার জন্য গাঁদা গাছের শাখা ৮-১০ সে. মি. লম্বা করে কাটতে হবে। বীজতলায় শাখা ডালের টুকরাগুলো দুয়েকটি পর্বসহ রোপণ করতে হবে। উপযুক্ত সময় হচ্ছে মার্চ মাস। নিয়মিত সেচ দিয়ে বীজতলা ভিজিয়ে রাখতে হবে। ২০-২৫ দিনের মধ্যে পাতা গজাবে।
লেখক ঃ তাসমিয়াহ তাবাসসুম প্রথমা
You cannot copy content of this page
Leave a Reply