কৃষি প্রতিবেদক ॥ বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে সাড়ে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে। এতে প্রায় দুই হাজার কোটি লিটার পানির ব্যবহার হয়। সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। পাম্পের মাধ্যমে সেচের পানি তুলতে গিয়ে চাপ পড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর। হাজার কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। আর এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬২ শতাংশ অর্থ খরচ করে থাকেন। অনেক দেশ ভূগর্ভস্থ পানি কৃষি কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সীমিত করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি ৩ থেকে ৮ মিটার নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্যমতে, ভূগর্ভের পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। পানির স্তর যত নিচে নেমে যাচ্ছে, বোরোর উৎপাদন খরচ ততই বাড়ছে।
এরপরও উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-৮১ সালে এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ২৮ হাজার লিটার। এর পর ২০০৬-০৭ সালে তা বেড়ে ৩২ হাজার লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন হাজার লিটারে ওঠেছে। প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে। কৃষকরাও ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির হিসাবে বর্তমানে দেশে কৃষি কাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩০টি। এর মধ্যে ডিজেল চালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদ্যুতে চলে মাত্র ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে ১ লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে। আগে এসব টিউবওয়েল ২০ থেকে ২২ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি ওঠানো হতো। কিন্তু এখন মাটির ২৮ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষক পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। এরপরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৭০-৭১ সালে প্রকৃতিনির্ভর আমন ও আউশ থেকে মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আসত। মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসত বোরো থেকে। আর এখন দেশের ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। আর ৩০ শতাংশ আসে আমন এবং ১০ শতাংশ আসে আউশ থেকে। এ সময়ে বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আট গুণ। এ সময়ে দেশে বর্ষার পানিনির্ভর আউশের চাষ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে। আর আমনের চাষ কমেছে ৪৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানি কম লাগে এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। তিনি বলেন, ভূ-উপরিস্তরের পানির ব্যবহার না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে না রাখতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। যদিও মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং অব্যবহিত পরে প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। অথচ এখন দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি, পাশাপাশি আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এরপরও আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনে সরকারকে জোর দিতে হবে। এ দুটি ফসল উৎপাদন খরচ কম। বৃষ্টির পানিতে আবাদ করা যায়। অথচ বোরো ধান আবাদে নিয়মিত সেচ দিতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে পড়ছে দেশ। বোরো উৎপাদনে রাসায়সিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় জীববৈচিত্রসহ নষ্ট হচ্ছে পানি, পরিবেশ ও মাটির উর্বরা শক্তি। কৃষিবিদ ড. আতাউর রহমান মিঠুন বলেন, আউশ ও আমনের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলছেন, বোরোতে সরকার সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের দিকে বিশেষ নজর দিলেও আমন আর আউশে তেমন নজর দিচ্ছে না। আমন ও আউশের উৎপাদন বাড়াতে হলে দেশীয় প্রজাতির ধানের পরিবর্ততে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ বাড়াতে হবে। বন্যা এলাকার জন্য বন্যা সহিঞ্চুজাতের ধানের আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
কৃষক বাড়তি অর্থ ব্যয় করে চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষি উৎপাদন। কৃষকদের ঘাম ঝরানোর পরিশ্রমে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। করোনাভাইরাসের মহামারিকালেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে রের্কড গড়েছে বাংলাদেশ। ধান উৎপাদনে একধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বে তৃতীয় বাংলাদেশ। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা যখন ঝুঁকিতে, তখনও সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদন ও মজুত নিয়ে স্বস্তিতে বাংলাদেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। খাদ্য উৎপাদনে স্বংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ধান, গম, ভুট্টা আলু, আম বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply