কৃষি প্রতিবেদক ॥ বাংলাদেশের কম-বেশি সব জায়গাতেই পেয়ারা চাষ হলেও বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, ফিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল¬া, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। আশার কথা হচ্ছে, এখন রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহরসহ দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়েও শখের ছাদবাগানে পেয়ারা চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই দেশে পেয়ারা চাষ অনেক লাভজনক। ফল উৎপাদনে অগ্রগামী বাংলাদেশ পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে ঠাঁই করে নিয়েছে। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে কাজী পেয়ারা চাষের মধ্য দিয়ে দেশে উন্নত জাতের পেয়ারা চাষ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ছয়টি উন্নত জাতের পেয়ারা এবং বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া থাই পেয়ারার চাষে বিপ¬ব ঘটে। ফলে দেশজুড়ে বিভিন্ন জাতের দেশি পেয়ারা চাষের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নতজাতের পেয়ারার চাষও হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম ২০০৬-০৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে উন্নত জাতের পেয়ারার বীজ এনে ২০১০ সালে ব্যাপকভাবে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যায়ে প্রায় ৪০ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পেয়ারা বাণিজ্যের সাথে জড়িত। পেয়ারার প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রজাতি থাকলেও বাংলাদেশে পেয়ারার জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে-কাজী পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-১ (মিষ্টি), বাউ পেয়ারা-২ (রাংগা), বাউ পেয়ারা-৩ (চৌধুরী), বাউ পেয়ারা-৪ (আপেল), ইপসা পেয়ারা-১, ইপসা পেয়ারা-২, কাঞ্চন নগর, মুকুন্দপুরী, থাই পেয়ারা, পলি পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা প্রভৃতি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমবেশি ২৭ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। বছরে কমবেশি ৩ লাখ ২৫ টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। সে হিসেবে দেশে পেয়ারার বাজার ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় ওঠানামা করে। পেয়ারা একরকমের সবুজ রঙের বেরি জাতীয় ফল। লাল পেয়ারাকে রেড আপেলও বলা হয়। পেয়ার উৎপাদনে বিখ্যাত বরিশাল জেলা। বরিশাল বিভাগের সব স্থানে পেয়ার ফলন হলেও উন্নত ও সুস্বাদু পেয়ারা বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে উৎপাদন হয়। একারণে তিন জেলাকে বলা হয় ‘পেয়ারা রাজ্য’। মৌসুমের তিন মাস পাকা পেয়ারার সুবাসে সুরভিত থাকে গ্রামের বাতাস। পেয়ারার রাজ্যখ্যাত ঝালকাঠি-বরিশাল-পিরোজপুর জেলার ৫৬টি গ্রাম। হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে পেয়ারার বাগান।
পেয়ারা পাতায় চা
পেয়ারা গাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পেয়ারা পাতারও রয়েছে বিশেষ গুণ। পেয়ারা পাতা দিয়ে এক প্রকার চা তৈরি করেছে জাপান, যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই চা মানব দেহকে সতেজ করে, দাঁত মজবুদ ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। পেয়ারা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে বাংলাদেশি পেয়ারা পাতার বিশ্ব বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
পেয়ারার থেকে জেলি
পেয়ারার জেলি পৃথিবী বিখ্যাত। বিদেশে বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা মূলত জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশে পেয়ারার জেলি উৎপাদন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এগ্রোবেইজড শিল্পে সরকারের মনযোগ প্রয়োজন।
পেয়ারা পাতা রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা
পেয়ারা পাতা দিয়ে এক প্রকার চা তৈরি করেছে জাপান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। জাপান, কোরিয়া, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ইতালি, ফ্রান্স ও গ্রীসে পেয়ারা পাতার চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। মানব দেহের জন্য বিশেষত ডায়েবেটিক রোগীদের এই চা খুবই উপযোগী। অরগ্যানিক পদ্ধতিতে যে সব পেয়ারা গাছ চাষ হয় সে পাতাই চা তৈরির জন্য বিবেচিত হয়। এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভিত্তিক পেয়ারা চাষ হলেও শুধু পেয়ারাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেসব এলাকায় পেয়ারা পাতার চা তৈরির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তুলতে পারলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি পেয়ারা পাতার ব্যপক চাহিদা তৈরি হবে।
বিচিমুক্ত পেয়ারা উদ্ভাবন
বিচিমুক্ত পেয়ারা ‘বারি পেয়ারা-৪’ জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক। এই পেয়ারা খেতে একটু কচকচে লাগে বা শক্ত থাকে। ২০০৫ সাল থেকে ১০ বছর গবেষণায় এই সফলতা আসে। গাজীপুর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মদন গোপাল সাহা বলেন, ‘বারি পেয়ারা-৪’ সম্পূর্ণ বিচিমুক্ত হওয়ায় এটি এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এই পেয়ারার প্রচার হচ্ছে। এই পেয়ারা ফল সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে সংগ্রহ উপযোগী হয়। সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশে অন্যান্য ফল খুব কম পাওয়া যায় তখন ফল আহরণ শুরু হয়। জাতটি পাহাড়ি অঞ্চলসহ ব্যাপক বিস্তৃৃত আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী।
যোগাযোগে বাড়বে সম্ভাবনা
বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়কপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকা। প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়। ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম ভিমরুলী থেকে নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, নাটোর, বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়কপথে যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেওয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনত। দেশের অন্যতম পেয়ারা অঞ্চল হলেও আজ অবধি এসব এলাকায় সরকারিভাবে কোনো হিমাগার নির্মাণ করা হয়নি। নেই কোন জেলি কারখানাও। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, হিমাগার ও জেলি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া অতি আবশ্যক।
লেখক ঃ এস এম মুকুল, কৃষি ও অর্থনীতি বিশে¬ষক ও কলাম লেখক
You cannot copy content of this page
Leave a Reply