কৃষি প্রতিবেদক ॥ বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। বাংলাদেশে আমন আবাদের ভরা মৌসুমে নদনদীতে পানি পাওয়া যায় না। উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। অথচ আগে আমন রোপণের সময়টায় ধানক্ষেতের পাশেই নালা-ডোবা, হাওড়-বিল পানিতে থাকত টইটম্বুর। এ পানি দিয়েই আমন ক্ষেতে সেচ দিতেন কৃষক।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ সেচের পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সারাদেশে প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি উঠেছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। পানির অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলে আমনের সবুজ ধানের চারা হলুদ বরণ হয়ে যায়। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। জলবায়ুর প্রভাবে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষ।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ এবং নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে ছোটবড় প্রায় ৩২০টি নদনদী রয়েছে। তন্মধ্যে ৫৭টি প্রন্তদেশীয় নদনদী দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত। ভূ-উপরিস্থ পানিসম্পদ বলতে দেশের উপর পতিত বৃষ্টিপাত এবং বহির্দেশ থেকে আগত পানি প্রবাহকে বুঝায়। দেশে ভূ-উপরিস্থ মোট পানিসম্পদের পরিমাণ ১,৩৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। তন্মধ্যে নদনদীতে ১,০১০ বিসিএম এবং বাকি ৩৪০ বিসিএম বার্ষিক বৃষ্টিপাত (২০০০-২৫০০ মিমি)। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ ২৯ হাজার ঘনমিটার। ভূ-উপরিস্থ পানি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) নদনদী, খাল-নালা, হাওর-বাঁওড় ও বিলে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে সাগর-মহাসাগরে পতিত হয়। তাই সারাবছর ভূ-উপরিস্থ পানি কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। মিঠা পানির এই বিশাল উৎসের দক্ষিণ ভাগের চিত্র ভয়ংকর। খুলনা, সাতক্ষীরা সব নদী পুকুরের পানি লবণে ভরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি ৩ থেকে ৮ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্যমতে, ভূগভের্র পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। পানির স্তর যত নিচে নামবে, ধান উৎপাদন খরচ ততই বাড়বে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-৮১ সালে এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ২ হাজার ৮০০ লিটার। ২০০৬-০৭ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০০ লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২০২২ সালে তা ১ হাজার ৬০০ লিটারে উঠেছে। প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে। কৃষকরাও ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে।
কৃষি প্রধান দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ সরাসরি এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নিভর্রশীল। দেশের ভূ-উপরিস্থ পানিসম্পদ- যা কৃষি ও মৎস্যসম্পদের উৎপাদনশীল রাখবে, তার নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামায় বিপাকে কৃষক। নদীর প্রবাহ ঠিক না করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা। মিঠা পানির প্রধান উৎস নদী। তাই নদী প্রবাহ ঠিক না করলে মিঠা পানির চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ। জলবায়ু গবেষকরা আশঙ্কা করে বলছেন, কৃষি সেচ ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানির চাহিদা বাড়ছে। যা সামনে আরও তীব্র হবে। এই সংকট মোকাবিলায় ভূগর্ভের পানির বিকল্প হতে পারে সাগর, নদী ও বৃষ্টির পরিশোধিত পানি। নদনদী, ঝর্ণা, বিপুল জলরাশি নিয়ে দেশের প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বয়ে চলেছে তিন শতাধিক নদী।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সেচের অবদান অপরিসীম। দেশে খাদ্য উৎপাদনে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম প্রচলিত আছে- বৃহৎসেচ ও ক্ষুদ্রসেচ। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্রসেচের মাধ্যমে দেশের সেচকৃত জমির প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং বৃহৎ সেচের মাধ্যমে প্রায় ৫ শতাংশ। বর্তমান সরকার সেচ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনায় সেচের পানির অপচয় রোধ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও সেচ খরচ হ্রাসের নিমিত্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ পানির সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সর্বোচ্চ পানির চাহিদা কৃষি উৎপাদনে। অর্ধ শতাব্দী আগেও ফসল আবাদে সেচপানির ব্যবহার ছিল নিতান্তই কম। মাটির আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা সহায়ক হওয়ায় অধিকাংশ আবাদি জমিতে বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর বিনা সেচে ফসল আবাদে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হতো না। ফসলবিন্যাস ও উৎপাদন ব্যবস্থাও ছিল অনন্য। শুষ্ক মৌসুমে উঁচু এলাকার জমিতে আবাদের জন্য মাটির প্রাকৃতিক আর্দ্রতার ভিত্তিতে ফসল নির্বাচন করা হতো। নিচু জমিতে বন্যার পানি নিষ্কাশনের পর বোরো ধানের চারা রোপণ করে পরবর্তী সময়ে সেচ দেয়া হতো। দেশের মোট আবাদি এলাকার মোটামুটি ১০ শতাংশ ছিল সেচের অধীন। নদনদী, খাল, বিল, ছড়া ও ডোবায় অফুরন্ত ভূ-উপরিস্থ পানির ভান্ডার ছিল। সেউতি বা দোন ও নালা ব্যবহারসহ বিভিন্ন স্থানীয় পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হতো। সেচযন্ত্র ও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার ছিল সীমিত। মোট আবাদি এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশে ফসল আবাদে সেচপানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে বৃষ্টিপাতের পর আউশ ধান, পাট ও অন্যান্য ফসলের বীজ বপন বা চারা রোপণ করা হতো। বর্ষাকালে রোপণ করা হতো আমন ধানের চারা। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে প্রাকৃতিক আর্দ্রতায় বপন করা হতো হরেক ফসলের বীজ। প্রতিটি ফসলের স্থানীয় উপযোগী অসংখ্য জাত ছিল। এসব জাতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল খরাসহিষ্ণুতা। বৃষ্টিপাত কম হলেও বা অনাবৃষ্টিতে টিকে থাকার ক্ষমতা ছিল। উচ্চফলনশীল জাতের ফসল আবাদ প্রসারে স্থানীয় জাতগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কৃষিতে বাড়ছে গভীর নলকূপের ব্যবহার। বোরো-আমন মৌসুমে সারাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ পাম্প ও শেলো মেশিন ব্যবহার হয়। প্রচলিত সেচ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রয়োজন প্রায় দেড় হাজার লিটার পানি। এতে সারাদেশেই ভূ-উপরিভাগের পানির স্তর প্রায় ত্রিশ ফুট নিচে নেমে গেছে।
পৃথিবীর পানিসম্পদের মধ্যে বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ, নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত। পানি সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং জনসংখার বৃদ্ধির মতো চলমান সমস্যাসমূহ মিটাতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ একটি পুনঃব্যবহার পদ্ধতি। বৃষ্টির পানিকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে পুনরায় ব্যবহারের নিমিত্ত জলাধার বা ট্যাংকে সংরক্ষণ করাকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ বলে। সাধারণত পাতকুয়া, টিনের চালা বা ভবনের ছাদে বৃষ্টির পতিত পানি সংগ্রহ করে পাইপের মাধ্যমে ভূতল বা ভূপৃষ্ঠের জলাধার বা ট্যাংকে জমা করা হয়। সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি প্রয়োজন অনুসারে খাবার, গৃহস্থালি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনা বা ছাদে সেচ প্রদান করা যায়। কৃষি, শিল্প ও জনবসতির পানি চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার চরম বিপদ ডেকে আনছে। এ থেকে বাঁচতে নদী, খাল ও জলাধার সচল করার বিকল্প নেই। তাই আন্তর্জাতিক ৫৭ নদীর প্রবাহ ঠিক করা জরুরি। শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করে রাজধানীর মিঠা পানির চাহিদার ৪০ ভাগ মিটছে। তাই সাগর ও নদীর নোনা পানি পরিশোধন করে স্থানীয়ভাবে মিঠা পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে পরামর্শ জলবায়ু ও পানি গবেষকদের।
বিশ্বব্যাংকের সেচ বিষয়ে পরামর্শক ডক্টর ইফতেখারুল আলম বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা; সেইসঙ্গে পানির উৎস তৈরি করতে হবে। নদী-নালা খনন ও বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানি কম লাগে- এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। তিনি বলেন, ভূ-উপরিস্তরের পানির ব্যবহার না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে না রাখতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনে সরকারকে জোর দিতে হবে। এ দুটি ফসলের উৎপাদন খরচ কম। বৃষ্টির পানিতে আবাদ করা যায়। অথচ বোরো ধান আবাদে নিয়মিত সেচ দিতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে পড়ছে দেশ।
লেখক ঃ ইমরান সিদ্দিকী
You cannot copy content of this page
Leave a Reply