কৃষি প্রতিবেদক ॥ কয়েক দশকের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পে সূচিত হয়েছে নতুন এক ধারা। কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং উচ্চশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের হাত ধরে শুরু হয়েছে এ পথচলা। প্রথাগত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে এবং পশ্চিমা ধাঁচের তথাকথিত ‘উন্নয়ন মডেল’ ভেঙে দেশীয় খামারিদের পেশাগত দক্ষতাবৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপদ ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনের ঐকান্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার ফসল। শুরুর দিকে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ছিল প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। একদিন বয়সি মুরগির বাচ্চা, ফিনিশড ফিড থেকে শুরু করে সবকিছুই আমদানি করা হতো। বলা যায়, বিদেশগামী কিংবা বিদেশ ফেরত একটি শিক্ষিত শ্রেণির এগ্রোবেইজড ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আগ্রহ বা দুর্বলতার কারণেই বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল পোল্ট্রি শিল্পের গোড়াপত্তন।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিমান বাংলাদেশের যাত্রীদের উন্নতমানের খাবার সরবরাহের তাগাদা থেকেই বিদেশ থেকে উন্নতজাতের পোল্ট্রি মুরগি আমদানির প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ চাহিদা থেকেই স্থাপিত হয় ‘বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্স’। ইউরোপ থেকে উন্নতজাতের মুরগির বাচ্চা দেশে এনে দেশেই শুরু হয় লালন-পালন। এসব মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা যদিও প্রাথমিকভাবে আমদানিকৃত ফিডের মাধ্যমেই পূরণ করা হতো; তবে বেসরকারি পর্যায়ে পোল্ট্রি পালন শুরু হওয়ায় দেশের ভেতরেই গড়ে উঠতে থাকে ফিড তৈরির কারখানা। এ অধ্যায়ের শেষ দিকে এসে আরও কিছু অগ্রগতি হয়- গড়ে উঠতে শুরু করে প্যারেন্টস্টক (পিএস) এবং গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) খামার। ফিড মিল থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক খামারেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। প্রযুক্তির আশীর্বাদে আমূলে পাল্টে যেতে শুরু করে দেশীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ। এ সময়ে দু-একটি ছোট আকারের পোল্ট্রি প্রসেসিং প্লাটও গড়ে উঠে। শুধু খামার ব্যবস্থাপনাতেই নয় বরং খামার পরিকল্পনাতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বড় বড় কোম্পানি গড়ে উঠে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছোট খামারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়িয়ে, নিজস্ব কোম্পানিতে উৎপাদিত ফিড, বাচ্চা ইত্যাদি সরবরাহের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে ইন্ট্রিটেড ফার্মিং শুরু করে। মানুষের ব্যস্ততা, চাহিদা ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বেই প্রসেসড ফুডের চাহিদা বাড়তে থাকে। শুরুতে বিদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত মুরগির মাংস থেকে প্রস্তুতকৃত খাদ্য বাংলাদেশে এলেও ধীরে ধীরে দেশীয় উদ্যোক্তারাও এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। একটি দুটি করে বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির বিভিন্ন পদের পোল্ট্রিজাত খাদ্যের পসরা সাজতে শুরু করে রাজধানী ঢাকার বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে। আকর্ষণীয় ও উন্নতমানের বাহারি মোড়ক ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ফলে এ সময় পণ্যের ব্রান্ডিংও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটা সময় পর্যন্ত কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটির দিকেই বেশি মনোযোগ ছিল উৎপাদকদের। ২০০৫ সালের দিকে এসে রপ্তানির চেষ্টা শুরু হয়। কিছুদিন রপ্তানি হয় একদিন বয়সি মুরগির বাচ্চা কিন্তু ২০০৭ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয়াবহ সংক্রমণে সে উদ্যোগটিও বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১১ সালের ধারাবাহিক সংক্রমণের কারণে ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই) এর লাল তালিকায় উঠে যায় বাংলাদেশের নাম। ফলে বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানির দরজা। তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অদম্য প্রচেষ্টায় বন্ধ সে দরজা আবারও খুলতে শুরু করেছে। ২০১৯ সালে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে শুরু হয়েছে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের রপ্তানি। খুব শিগগিরই প্রতিবেশী দেশ নেপালে একদিন বয়সি মুরগির বাচ্চা ও হ্যাচিং ডিম রপ্তানি শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উন্নয়ন সূচকে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও পোল্ট্রি মুরগির মাংস কিংবা মাংসজাত পণ্য রপ্তানিতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও বেসরকারি উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে লাইন-মিনিস্ট্রি সবাই ইদানীং পোল্ট্রি রপ্তানির সম্ভাবনার কথা বলছেন। ২০২৪ সাল নাগাদ রপ্তানির টার্গেটও একরকম নির্ধারণ করা হয়েছে; তবে মুখে বলা আর বাস্তবে অর্জন করা এক কথা নয়। মূলত এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রয়োজনীয় কাজগুলো ধাপে ধাপে শেষ করতে হয়। এ ধাপগুলোর কোনো একটি বাদ পড়লে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়া প্রায় অসম্ভব। যে দেশগুলো বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস কিংবা প্রসেসড খাদ্যের বাজার দখল করে আছে তারা কীভাবে আজকের অবস্থানে এসেছে, কীভাবে নিজেদের কমপ্লায়েন্ট এবং কমপিটেন্ট করে তুলেছে- তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। একটি বিষয় না বললেই নয় যে, আমাদের দেশে কিন্তু এখন আর বিনিয়োগের ঘাটতি নেই। এক সময় কোয়ান্টিটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন সে ধাপও আমরা পার হয়ে এসেছি। এখন কোয়ান্টিটি নয় বরং কোয়ালিটির দিকেই ঝুঁকেছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প।
লেখক ঃ শামসুল আরেফিন খালেদ, পরিচালক, নারিশ পোল্ট্রি গ্র“প।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply