কৃষি প্রতিবেদক ॥ পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, আয় বৃদ্ধি এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অন্য প্রাণীর তুলনায় খরগোশ সহজেই পালন করা যায়। এটির খাদ্য এবং ব্যবস্থাপনা সহজ বিধায় বাড়ির মহিলা ও ছেলেমেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সহজেই খরগোশ পালন করতে পারেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, চীন জাপানসহ অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালন হয়। বাংলাদেশে এটির পালন এবং মাংস এখনো জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। তবে বিআরডিবি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কিছু বেসরকারি সংস্থা খরগোশ পালনে খামারিদের উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খরগোশ পালন অত্যন্ত লাভজনক। খরগোশ প্রজাতি : বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির যে খরগোশ দেখা যায়, তন্মধ্যে সাদা, কালো, ডোরা এবং খয়েরি রঙের খরগোশ বেশি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত জাতসমূহের মধ্যে ডার্ক গ্রে (নেটিভ), ফক্স, ডাচ, নিউজিল্যান্ড লাল, নিউজিল্যান্ড সাদা, নিউজিল্যান্ড কালো, বিলজিয়াম সাদা এবং ছিনছিলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। খরগোশ পাবেন কোথায় : কাঁটাবনের দি বার্ডস বিতানের বিক্রয়কর্মী বরুণ দাস জানান, ঢাকার কাঁটাবন, মিরপুর, কাপ্তান বাজারসহ বিভিন্ন পশু-পাখি ও অ্যাকোয়ারিয়ামের দোকানে পাওয়া যায় খরগোশ। গাজীপুরের টঙ্গী মার্কেট, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা খরগোশ পালনের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে খরগোশ কিনতে পাওয়া যায়।
খরগোশ পালনের সুবিধা- ১. এটি দ্রুত বর্ধনশীল প্রাণী। ২. বাচ্চা দেওয়ার হার অত্যধিক, একসাথে ২-৮ টি বাচ্চা প্রসব করে। ৩. প্রজনন ক্ষমতা অধিক এবং এক মাস পরপর বাচ্চা প্রদান করে। ৪. খাদ্য দক্ষতা অপেক্ষাকৃত ভালো। ৫. মাংস উৎপাদনে পোল্ট্রির পরেই খরগোশের অবস্থান। ৬. অল্প জায়গায় স্বল্প খাদ্যে পারিবারিক পর্যায়ে পালন করা যায়। ৭. অল্প খরচে অধিক উৎপাদন সম্ভব। ৮. খরগোশের মাংস অধিক পুষ্টিমান সম্পন্ন ও উন্নত মানের। ৯. সব ধর্মের লোকই এটির মাংস খেতে পারে, তাতে কোনো সামাজিক বাধা নেই। ১০. রান্নাঘরের উচ্ছিষ্টাংশ, বাড়ির পাশের ঘাস এবং লতাপাতা খেয়ে এটির উৎপাদন সম্ভব। ১১. পারিবারিক শ্রমের সফল ব্যবহার করা সম্ভব। ১২. বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং বড় বড় ভোজসভায় এদের মাংসের যথেষ্ট সমাদর আছে। পালন পদ্ধতি : বাড়ির ছাদে বা বাড়ির আঙিনা অথবা বারান্দায় অল্প জায়গায় বিনিয়োগ করে ছোট আকারের শেড তৈরি করে খরগোশ প্রতিপালন করা যায়। দুই পদ্ধতিতে খরগোশ পালন করা যায় হয়ে থাকে। লিটার পদ্ধতি : কম সংখ্যক খরগোশ পালনের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী। খোরগোশ পালনের জন্য মেঝে কংক্রিটের হওয়া উচিত। কেননা খোরগোশ মাটি খুঁড়ে গর্ত বানায় যা অত্যন্ত বিরক্তিকর। লিটার পদ্ধতিতে মেঝের ওপর ৪-৫ ইঞ্চি পুরু করে তুষ, কাঠের ছিলকা অথবা ধানের খড় ইত্যাদি ছড়িয়ে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে খরগোশ পালন করতে হলে একসাথে ৩০টার বেশি খরগোশ প্রতিপালন করা ঠিক নয়। সে ক্ষেত্রে পুরুষ খরগোশ অবশ্য আলাদা ঘরে রাখতে হবে তা না হলে খরগোশ সহজে রোগাক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া খরগোশকে সামলানোও খুব অসুবিধা হয়।
খরগোশ প্রতিপালনের জন্য আমাদের দেশে সাধারণত পরিবহনযোগ্য নেটের খাঁচা বা কাঠের বাক্স ব্যবহার করা হয় যা খামারিরা দিনের বেলায় ঘরের বাইরে এবং রাতে ঘরের ভেতরে আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো এলাকাতে পুরুষ এবং স্ত্রী খরগোশকে একসাথে রাখা হয়। কিন্তু বাচ্চা দেওয়ার পর পুনরায় বাচ্চাসহ স্ত্রী খরগোশকে আলাদা করে ফেলা হয়। শুধু প্রজননের জন্য পুরুষ খরগোশকে স্ত্রী খরগোশের নিকট ১০-১৫ মিনিট ছেড়ে দেওয়া হয়। খাঁচা পদ্ধতি : বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালনের জন্য খাঁচা পদ্ধতি বিশেষ জনপ্রিয়। সে ক্ষেত্রে খাঁচার জন্য লোহার পাত দিয়ে তৈরি ৩-৪ তাকবিশিষ্ট খাঁচা অধিক উপযোগী। লক্ষণীয়, খরগোশের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রেখে প্রতিটি তাকে খোপ তৈরি করতে হবে।
খাঁচাতে খরগোশের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা ঃ- ক) একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ খরগোশের জন্য ৪ বর্গফুট। খ) পূর্ণবয়স্ক মা খরগোশের জন্য ৬ বর্গফুট (প্রসূতি ঘরসহ) এবং গ) বাচ্চা খরগোশের জন্য ১.৫ বর্গফুট।
পূর্ণবয়স্ক খরগোশের খাঁচা তৈরি করার জন্য খাঁচার দৈর্ঘ ১.৫ ফুট, প্রস্থ ১.৫ ফুট এবং উচ্চতা ১.৫ হওয়া উচিত। এরূপ খাঁচায় বাড়ন্ত দুটি খরগোশ প্রতিপালন করা যাবে। বড় আকারের খরগোশের জন্য খাঁচার দৈর্ঘ্য ৩ ফুট, প্রস্থ ১.৫ ফুট এবং উচ্চতা ১.৫ ফুট বিশিষ্ট খাঁচা উপযোগী। উল্লেখ্য, ২০ ফুট লম্বা, ১৩ ফুট প্রস্থ এবং ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের অথবা পাকা ঘরে প্রায় ১৫০-২০০টি খরগোশ খাঁচায় লালন পালন করা যায়।
বাংলাদেশে খরগোশকে সাধারণত শখের বা পোষা প্রাণী হিসেবে পালন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালন করা হচ্ছে। খরগোশের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং বড় বড় ভোজসভায় এদের মাংসের যথেষ্ট সমাদর আছে। খরগোশের মাংসে প্রোটিন, শক্তি, মিনারেল ইত্যাদির পরিমাণ বেশি এবং ফ্যাট, সোডিয়াম এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম। তা ছাড়া গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে খরগোশ পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আয়ের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। খরগোশের মাংস একদিকে যেমন প্রাণিজ আমিষের একটি চমৎকার উৎস হতে পারে, অন্যদিকে অভাবগ্রস্ত মহিলা ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের একটি বিরাট উৎস হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে।
লেখক ঃ মো. আব্দুর রহমান, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply