ঢাকা অফিস ॥ দেশে উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে বাল্যবিয়ের হার । জরিপ বলছে, গত ২৫ বছরে বাল্যবিয়ের হার বাড়তে বাড়তে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মহামারীর সময় দেশে বাল্যবিয়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাল্যবিয়ের কারণে দেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়ের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অকালে গর্ভধারণের ফলে নানারকম জটিল শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনকি অনেক কিশোরী অকালে মৃত্যুবরণও করছে। জানা যায়, করোনা সংক্রমণের পর দেড় বছরে অভিভাবকের আয় কমে যাওয়া ও স্কুল বন্ধ থাকা এ দুটিকেই সংশ্লিষ্টরা বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চিহ্নিত করছেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, দরিদ্র পরিবারের দৈনিক উপার্জন কমে যাওয়া, শহর থেকে অনেক পরিবারের গ্রামে স্থানান্তর, অসচেতনতা, কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা দিতে না পারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা, মহামারীতে কম খরচে এবং যৌতুক না লাগায় বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। এ অবস্থায় দেশব্যাপী ‘বাল্যবিয়ে রুখব/সম্ভাবনার আগামী গড়ব’ স্লোগানে ‘ওয়ান মিলিয়ন প্লেজড-টু অ্যান্ড চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির আওতায় মার্কিন সরকারের সহযোগিতা সংস্থা ইউএসএইড এ উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে উজ্জীবন, সেভ দ্য চিলড্রেন ও বিসিসিপি। এর লক্ষ্য ১ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো; যারা বাল্যবিয়ে বন্ধের অঙ্গীকারনামায় অংশ নেবেন। ইতিমধ্যে ভার্চুয়ালি অঙ্গীকার সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মা-বাবারা অনেকটা লুকিয়ে এবং রাতের আঁধারে কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কিছু বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই আটকানো যাচ্ছে না। আবার শহরের তুলনায় গ্রামেই বেশি বাল্যবিয়ে ঘটছে। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত জেলা এবং উত্তরাঞ্চলে বাল্যবিয়ে বেশি ঘটছে। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগ ২০২০ সালে দেশের ১১ জেলায় নারী ও কিশোর-কিশোরীদের ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব বিস্তারের ভিত্তিতে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায়, মহামারীর কারণে দেশে বাল্যবিয়ের হার আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এটি ২৫ বছরে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হার। আবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি (শতকরা ৫১)। বাল্যবিয়ের হার বেশি বিশ্বের এ রকম ১০টি দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়েছে, যেসব মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তার শতকরা ৫০.৬ জনের বিয়ে হয়েছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যে। শতকরা ৪৭ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫-এর মধ্যে। শতকরা ১ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। এ সময় দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে বরগুনায় ১ হাজার ৫১২, কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষীপুরে ১ হাজার ৪১ ও কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি। আর বাল্যবিয়ের উদ্যোগ যারা নিয়েছেন এর শতকরা ৭৮ জনই ভুক্তভোগীর বাবা-মা। সংস্থাটির আরেক হিসাব বলছে, দেশের ৫৯% মেয়েকে ১৮ বছর বয়সের আগেই আর ২২% মেয়েকে তাদের ১৫তম জন্মদিনের আগে বিয়ে দেওয়া হয়। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, অনেক উন্নতির পরও বাংলাদেশ বাল্যবিয়েতে চতুর্থ স্থানে ছিল। করোনাভাইরাস লাখ লাখ কন্যাশিশুকে নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ, বন্ধু ও সাপোর্ট নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্নতা, ক্রমবর্ধমান অভাব এই মেয়েদের বিয়ের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। এ হেল্পলাইনের প্রতিটি উপজেলায় মোবাইল টিম আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন। এ ছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ হেল্পলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। হেল্পলাইনটির ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বলেন, ‘করোনার সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে গ্রাম ও শহরে অনেক কিশোরী অসচ্ছল পরিবারগুলোর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরি হারিয়ে অনেক পরিবারের অভিভাবক একজন সদস্য কমাতে মেয়ের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন।’
You cannot copy content of this page
Leave a Reply