কৃষি প্রতিবেদক ॥ বিগত দুই দশকে জৈব কৃষির গতিশীল প্রসারের পরও পুরো পৃথিবীর মাত্র এক শতাংশ কৃষি জমি জৈব কৃষিবিদ্যার আওতাধীন। সমালোচকদের মতে, জৈব কৃষি পদ্ধতিতে সমপরিমাণ শস্য উৎপাদনের জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অধিক কৃষি জমি প্রয়োজন। তবে গবেষণাপত্রটি স্পষ্টত দেখিয়েছে, কেন জৈব পদ্ধতি প্রচলিত কৃষি পদ্ধতির চেয়ে এগিয়ে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও জৈব উপায়ে উৎপাদিত পণ্যকে অরগ্যানিক পণ্য বলে অভিহিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাবার, ভেষজ ও প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে রোগবালাই দমন করা হয়। বিপণন পদ্ধতিতেও অনুসরণ করা হয় জৈব প্রযুক্তি। বিশ্বব্যাপী অরগ্যানিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকৃত পোলট্রি, ডেইরি, মৎস্য ও কৃষিজ পণ্যের ভোক্তা চাহিদা বাড়ছে। মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর উপাদানমুক্ত ও অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ অরগ্যানিক খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটানোয় এর উৎপাদন পদ্ধতিরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নাম করে দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার সূচনা হয়। কিন্তু এই কৃষিকাজে অবিবেচকের মতো অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করে মাটির উপকারী অণুজীবগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি কমেছে। এইসব বিষ জলাশয়ে জমে ধ্বংস করে ফেলেছে সুস্বাদু দেশি মাছ এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এই ক্ষতি আমাদের নিরাপদ খাদ্যের জন্য অন্যতম হুমকি। এ কারণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। জৈব কৃষি এমন একটি আদর্শ পদ্ধতি, যা প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বিত ও টেকসই। জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের জৈবসারের উৎস হচ্ছে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, কেঁচো সার, উদ্ভিদ ও জৈব উৎস থেকে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা, ছাই। জৈব কৃষি পদ্ধতিতে মাটি সবসময় উর্বর থাকে। জৈব কৃষিতে কিছু কিছু পাতা, কান্ড, ডাল, মূল বা বাকলের রস কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক প্রকার গাছগাছড়া আছে যেগুলো পশুপাখির নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো বলছে, জৈব চাষের জন্য বাংলাদেশের জমি সবচেয়ে উপযুক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশের মাটির ভলিউম এবং সূর্যালোকের প্রাচুর্যের কারণেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বায়োমাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশের ওই উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে তাপমাত্রা কখনো মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদানের প্রাচুর্য বজায় থাকে। এর ফলে গাছপালাও পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে। এ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক চাষাবাদে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, যা সারা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজিতে অনুষ্ঠিত ১৭তম বিশ্ব অরগ্যানিক সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অপরচুনিটিস অন অরগ্যানিক ফার্মসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জমির এ সম্ভাবনাময় দিকটি তুলে ধরা হয়। অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের উপযুক্ত জমি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, নদী ও উপকূলীয় চরাঞ্চল এবং বসতভিটার আঙিনা ও চারপাশ এবং নগর এলাকার বাড়িঘরের ছাদগুলোকে নির্বাচন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, দেশের মোট জমির অন্তত ১০ শতাংশ অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। বিশেষজ্ঞগণের মতে, অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অরগ্যানিক সুগন্ধি চাল, শাকসবজি, ফল, মাশরুম, চা, অরগ্যানিক পাট, অরগ্যানিক মাছ ও অরগ্যানিক মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বেশি নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইনকানুন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অনুসন্ধানে জার্মানির মতো দেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন, অরগ্যানিক ফার্মিং হলো সেই মহৌষধি, যা দিয়ে একাধারে জলবায়ু ও পরিবেশকে বাঁচানো যাবে, অন্যদিকে ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যার সমাধান করা যাবে। বিশ্বব্যাপী অরগ্যানিক ও প্রথাগত কৃষির মধ্যে উৎপাদনের ফারাক গড়ে প্রায় ২৫ শতাংশ। এর মূল কারণ অরগ্যানিক কৃষি বিভিন্ন প্রকৃতিদত্ত উপাদানের ওপর অনেক বেশি নির্ভর। গিসেন-এর ইউস্টুস লাইবিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অরগ্যানিক কৃষি বিষয়ের অধ্যাপক আন্ড্রেয়াস গাটিংগারের মতে, খাদ্যের অপচয় বন্ধ করে ও প্রকৃতিদত্ত কীটনাশক ব্যবহার করে শুধু হাজার কোটি কেন, বারোশ কোটি মানুষকেও খাওয়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গাটিংগার ‘ল্যান্ড শেয়ারিং’-এর ওপর জোর দেন, যার মূলমন্ত্র হলো একই জমি কৃষি, বন্যপ্রাণী ও জলবায়ু সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা। তার মতে, অরগ্যানিক ফার্মিং ঠিক সেই কাজই করে। জৈবসার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং সবজির উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। জৈবসার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন খরচ রাসায়নিক সারের চেয়ে শতকরা ৫০-৬০ শতাংশ কম হয়। জৈব পদ্ধতিতে জমিতে দীর্ঘ মূল ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের মূল বিশিষ্ট সবজির সমন্বয় ঘটিয়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ করা সম্ভব। কম খরচে শস্যে এ ধরনের জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষকদের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যও রক্ষা করা সম্ভব।
অরগ্যানিক কৃষি পদ্ধতিতে সাফল্য পেয়েছে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা। দেশটির কৃষকরা সমসাময়িক আবহাওয়া ও মাটির গঠন নিয়ে অরগ্যানিক কৃষি আবাদে বিপ্লবের ডাক দেন। বর্তমানে দেশটির কৃষকরা ৭০-৮০ কোটি ডলারের অরগ্যানিক কৃষিপণ্য রপ্তানি করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজি এলাকা। এলাকাটি জৈব কৃষি চাষের জন্য বিখ্যাত। জানজির কৃষকদের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামগ্রিক কৃষির টেকসই উন্নয়নে অরগ্যানিককে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিউল। একটি ছোট্ট এলাকায় অরগ্যানিক পদ্ধতিতে আবাদ-সাফল্য গোটা দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক কৃষি পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply