1. andolonerbazar@gmail.com : AndolonerBazar :

বিদ্যুত খাতের জন্য সরকারের আবারো নতুন মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ

  • সর্বশেষ আপডেট : শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১

ঢাকা অফিস ॥ সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গত এক দশকে দুটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়। কিন্তু ওসব মহাপরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হলেও সঞ্চালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে গত এক দশকে নেয়া পরিকল্পনাগুলো খুব একটা কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে পুরনো পরিকল্পনাগুলোকে পর্যালোচনা করে নতুন একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাতে জ্বালানি মিশ্রণ, সঞ্চালন ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা ও চাহিদা বিবেচনায় নতুন কেন্দ্র স্থাপনের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান মহাপরিকল্পনায় চাহিদা নির্দিষ্ট হারে বাড়বে ধরে নিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসেবে তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছিল। তারপর ৫ বছর কেটে গেলেও প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। যদিও এই সময়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১৬ পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারণ বর্তমান পরিকল্পনায় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উৎপাদন-চাহিদা, মিশ্র জ্বালানির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত কম গুরুত্ব পাওয়ায় নানা দিকে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে দেশের বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তেলের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর পরিকল্পনা পর্যালোচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যথাসময়ে উৎপাদনে আসেনি সেগুলো কমিয়ে ফেলা হবে। ওসব জায়গায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বিদ্যুতের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখা হচ্ছে। সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির সংস্থানের পাশাপাশি উৎপাদন মূল্য নিয়ন্ত্রণে ফুয়েল মিক্সিং বা জ্বালানি মিশ্রণ করা হয়ে থাকে। মূলত সুলভ জ্বালানিনির্ভর কেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তবে সেটি প্রাপ্যতা বিবেচনায় নিয়ে অন্য জ্বালানির ওপরও নির্ভরতা বাড়ানো হয়। বিদ্যমান মহাপরিকল্পনায় জ্বালানি মিশ্রণের যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। পিএসএমপি-২০১৬ অনুযায়ী মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লায় হবে ৩৫ ভাগ, আর গ্যাস ও এলএনজিতে ৪৫ ভাগ হবে। তাছাড়া তরল জ্বালানি থেকে আসবে ১০ ভাগ। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে ১০ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে তেল ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিংহভাগ আসছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেক। বিদ্যুৎ বিভাগ বাকি বিদ্যুৎ ব্যবহারে কোনো খাত তৈরি করতে পারেনি। তাছাড়া পুরোদমে উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পাশাপাশি বেসরকারি আরো দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সব মিলিয়ে এ বছর শেষ নাগাদ আরো প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি, উপযোগী এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অগ্রাধিকার দিয়ে ২০১০ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১০ তৈরি করা হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের (জাইকা) সহায়তায় বিদ্যুৎ খাতের প্রথম ওই মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সরকার। পিএসএমপি-২০১০-এ মিশ্র জ্বালানির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কয়লা থেকে ৫০ শতাংশ (দেশীয় ৩০ ও আমদানি ২০), ২৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস, ২০ শতাংশ পরমাণু ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং ৫ শতাংশ তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশীয় উৎপাদনে কয়লার ঘাটতি, ক্রমাগত প্রাকৃতিক গ্যাস কমে আসা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পরমাণু প্রযুক্তি সুযোগ তৈরি না হওয়ায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১৬’ প্রণয়ন করা হয়। মূলত ২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে ভিত্তি ধরেই বিদ্যুতের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। দেশীয় ও আমদানীকৃত গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো, বিদ্যুতের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করে দেশে অর্থনীতির টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন করা। কিন্তু ওই মহাপরিকল্পনার অনেক লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা এখন পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন পড়ছে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের ব্যবহার কমিয়ে আনতে ইতিমধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার অংশ হিসেবে তেলচালিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও দ্রুত বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী ৪ বছরের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়ায় তেলভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও রেন্টাল-কুইক রেন্টাল আরো কিছু কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিবেচনায় নবায়ন করা হয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি। জ্বালানি তেলনির্ভর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধের কথা বলা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। উল্টো অনেক রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মেয়াদ নতুন করে বাড়ানো হচ্ছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির কারণ দেখিয়ে ওসব কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ছে। অথচ তাতে দেশের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া দেশে নতুন নতুন আরো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আসছে। ফলে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় ২০ শতাংশের মতো বেশি রাখা হয়। যদিও এদেশে তা প্রায় ৫০ শতাংশের মতো। তাছাড়া বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়ার কারণে যোগ্য ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনায় ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ এলএনজি থেকে ব্যবহারের কথা বলা হলেও চলতি বছরে তা ৫ শতাংশও করা যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় করা যায়নি। অন্যদিকে মোট বিদ্যুতের ১৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছর পর্যন্ত তা ২ শতাংশের বেশি হয়নি। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম জানান, মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো কমানো উচিত। উন্নয়নশীল দেশে এতোগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর দিকে বেশি করে নজর দিতে হবে। গ্যাস আমদানি করে হলেও দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সচল রেখে সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে ঠিক রাখা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘাটতি রয়েছে এমন বিষয়গুলোকে নতুন মহাপরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশেষত বিদ্যুতের চাহিদা তৈরিতে এবার জোর দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তাছাড়া ২০৪০ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুতের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টিকে সামনে রাখা হচ্ছে। একই প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, দেশে মূলত বৈশ্বিক জ্বালানির বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যের ওপর এদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরশীলতা যেহেতু বাড়ায় এর বিকল্প কিছু নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কমানোর বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। চালু হওয়ার অপেক্ষায় আরো কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সব মিলিয়ে মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনাই সরকারের লক্ষ্য। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট। তার মধ্যে ক্যাপটিভ সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট। ফলে সক্ষমতা সব মিলিয়ে ১৫-১৬ হাজারের বেশি নয়। বাস্তবিক অর্থে উৎপাদন ও চাহিদা ঠিকই রয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

আরো খবর
© All rights reserved ©2021  Daily Andoloner Bazar
Site Customized By NewsTech.Com