সাজ্জাদ রানা ॥ ভরা বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে বেড়েছে চালের দাম। মানভেদে সব ধরনের চালের কেজিতে ২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধানের বাজার বাড়ায় চালের বাজার বেড়েছে বলে দাবি মিল মালিকদের। সামনে চালের বাজার আরো বাড়তে পারে বলে আভাস মিলেছে। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা যাদের ধান ও চাল ব্যবসার লাইসেন্স নেই এমন লোকজন ধান ও চাল কিনে মজুদ করার কারনেও বাজারে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এসব মজুদদারদের চিহিৃত করার দাবি মিলারদের।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে খাজানগর মোকাম ঘুরে চালের দাম বাড়ার বিষয়টি জানা গেছে। মিল মালিকরা বলেন,‘ গত এক সপ্তাহ ধরে ধানে বাজার বাড়তি। সব ধরনের ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতিদিন ধানের বাজার বাড়ছে। তাই ধানের বাজারের সাথে সমন্বয় করে চালের দাম নির্ধারন করা হচ্ছে। তবে এমন ভরা মৌসুমে ধানের দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছেন মিল মালিকরা। তারাও বিষয়টি ভেবে পাচ্ছেন না।
একাধিক মিল মালিক বলেন,‘ এবার আবহাওয়া ভালো ছিল । সময়মতো ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষকরা। ধান শুকনো থাকায় কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন প্রথম থেকেই। অন্যান্যবার যেখানে কৃষকরা ভেজা ধান বিক্রি করেছেন কম দামে সেখানে এবার শুকনো ধানে বেশি দাম পাচ্ছেন । তাই যে কৃষক আগে ১০০ মণ ধান বিক্রি করে যে অর্থ পেতেন সেখানে এখন ৭০ মন বিক্রি করে সেই অর্থ পাচ্ছেন। এতে কৃষকদের ঘরে অনেক ধান থেকে যাচ্ছে।
তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কুষ্টিয়ার ৪৬টি অটো মিল মালিকরা বোরো ধান বাজারে আসার সাথে সাথে প্রচুর ধান কিনেছেন। তারা প্রথম দিকে কম দামে ধান ক্রয় করেন। এসব ধান তাদের গুদামে রয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত তারা ধান ক্রয় করছেন। এসব ধানও মজুদ রাখছেন তারা।
কয়েক মাস আগেও খাজানগর মোকামে চালের কেনাবেচা কম থাকলেও এখন প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন প্রতিটি মিল মালিক। তারা সক্ষমতার থেকে বেশি চালের অর্ডার পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সময়মতো তারা ডেলিভারি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশি করে চাল কিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মজুদ করছেন। মিলে দাম বাড়লে তারা আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লুটছেন।
খাজানগর এলাকার মিল মালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, গত ৪/৫ বছরে এবারকার মত পরিস্থিতি তারা দেখেননি। ভরা মৌসুমে সাধারনত ধান ও চালের দাম বাড়ে না। আরো কমে। এবার মাস খানেক আগে ধান বাজারে আসা শুরু করলে দাম কিছুটা কম ছিল। তখন চালের বাজার কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা কমে যায়। এখন মাস না পেরুতেই ধানের বাজার বেড়ে যাচ্ছে। এতে চালের বাজার বাড়ছে। ধানের বাজারে দাম কমার কোন লক্ষন নেই। তাই সামনে চালের বাজার বাড়তে পারে।’
নজরুল নামের একজন মিল মালিক বলেন, আঠাশ জাতের ধান গত সপ্তাহে কিনেছিলেন ৯৫০ টাকা দরে। এখন সেই ধান ১ হাজার ৫০ টাকা। সরু জাতের ধান এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকা। একটু কমবেশি আছে এলাকা ভেদে। এছাড়া ২৯ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে হাজারের কাছে। অনেকে ২৯ জাতের ধান বস্তায় ভরে আঠাশ বলে বিক্রি করছেন। আর আঠাশ সরু বলে বিক্রি করছেন বলে জানান তিনি।’
খাজানগরে বেশির ভাগ মিল এখনো ম্যানুয়াল। এসব মিল মালিকরা অনেকটা কোণঠাসা। তারা অটো মিল মালিকদের কাছে অনেকটা জিম্মি। একজন মিল মালিক বলেন, অটো মিলের মালিকরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন পান। তাদের বড় বড় গুদাম রয়েছে। তারা ধান কিনে মজুদ করেন। তাদের সাথে কেউ পেরে ওঠে না। বাজার তারা যেমন ইচ্ছা তেমন পরিচালনা করেন। আমরা চাল তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রি করি। তারা লাভ করেন আমাদের থেকে বেশি।’
মিল মালিকরা বলেন, কৃষকরা গত কয়েক বছর ধরে বেশি দামে ধান বিক্রি করে আসছেন। তারা ১ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত ধান বিক্রি করেছেন। সরকার যেখানে মোটা ধানের দাম নির্ধারন করেছে ১ হাজার ৮০ টাকা। সেখানে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করবে কিভাবে? তাই সামনে ধান ও চালের বাজার বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভারত থেকে চাল না আনলে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে।’
খাজানগরের একটি বড় অটো মিলের গেটে প্রতিদিনের দর তালিকায় দেখা যায় মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা, কাজললতা ও আঠাশ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, বাসমতি বিক্রি হচ্ছে ৬২.৫০ টাকা, স্বর্ণা ৪০.৫০ টাকা।
ধানের যে দর লেখা আছে তাতে দেখা যায় সরু ধান যাকে মিনিকেট বলা হয় সেই ধান ৩৫.৫০ টাকা, কাজললতা ও আঠাশ ৩১.৫০ টাকা, বাশমতি ৩৫ টাকা ও ¯¦র্ণা ২৭.৫০ টাকায় কিনছেন তারা। এক সপ্তাহ আগেও এ দর কেজি অনুযায়ী ২ থেকে ৩ টাকা কম ছিলো।
চালকল মালিক সমিতির একাংশের সাধারন সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন,‘ এবার ব্যাতিক্রম মনে হচ্ছে অন্যান্যবারের তুলনায়। আবহাওয়া ভালো থাকায় ধান ঘরে তুলতে পেরেছে কৃষকরা। তারা বাজার বুঝে ধান বিক্রি করছে। বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় ধান কম আসছে। কৃষকদের ঘরে এখনো প্রচুর ধান আছে। আমরা অর্ডার পাচ্ছি অনেক বেশি। চালও সরবরাহ হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। তবে ধানের বাজার বেশি। তাই চালের বাজারে এর কিছুটা প্রভাব বাড়ছে। এর বাইরে অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টানার কথাও বলেন তিনি। তবে দেশে প্রচুর ধান ও চাল আছে বলে জানান তিনি।’
চালকল মালিক সমিতির অন্য অংশের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, প্রতি বছর বোরো মৌসুমে সাধারনত ধানের ও চালের বাজার কমে আসে। এবার ব্যাতিক্রম। প্রথম দিকে ধানের বাজার হাজারের নিচে ছিলো। তখন চালের বাজারও কমে আসে। এখন আবার সব ধরনের ধান হাজারের উপরে। এমনকি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এমনটা হওয়ার কারনে চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন যারা ভুট্টা ও পাট ব্যবসা করেন এমন লোকজনও ধান ও চাল কিনে মজুদ করছেন। এদের চিহিৃত করতে হবে। এসব লোকের কারনে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছি।’
দেশের সব থেকে বড় চালের ব্যবসায়ী কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদ। এছাড়াও স্বর্ণা অটো, বায়েজীদ আটো, জিন্নাহ অটো, দেশ এগ্রোসহ বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছে। রশিদ ও বায়েজীদ চালের দমা অন্যদের তুলনায় বেশি বিক্রি করে। তারা যে কোন ব্যবসায়ীর তুলনায় চালের দাম ১ থেকে ২ টাকা বেশি রাখে।
অন্যদিকে খাজানগরের প্রবীন ব্যবসায়ী আরশাদ আলী বলেন,‘ দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর ধান ও চাল রয়েছে। সংকট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সবাই ব্যবসা করতে চাই। তাই ইচ্ছা করলেই দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মোকামে ধানও কম আসছে। প্রয়োজন মত ধান তারা কিনতে পারছেন না। কৃষকরাও চড়া দামে ধান বিক্রি করতে চান। এ কারনে ধান ও চালের দাম বাড়ছে। তবে তা ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে আছে।’
তবে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা এসএম তাহসিনুল হক বলেন, তাদের লাইসেন্স ছাড়া কেউ ধান ও চালের ব্যবসা করতে পারবে না। মিল মালিকরাও ইচ্ছা করলেও বেশি মজুদ করতে পারবে না। তাই তারা এ বিষয়টি মনিটরিং করছেন। অবৈধ মজুদকারিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’