আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ একজন মুমিন সারা দিন রোজা রাখার পর সূর্যাস্তের সাথে সাথে যে খাবার গ্রহণ করে তার রোজাকে ভঙ্গ করেন, ইসলামের পরিভাষায় তাকে ইফতার বলা হয়। ইফতার একটি ইবাদত। যেকোনো ইবাদতের জন্য কুরআন-সুন্নার বিধান রয়েছে; সে বিধান অনুযায়ী যদি ইবাদত করা যায় তাহলে আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং সাওয়াব পাওয়া যাবে। ইফতারের সুন্নত নিয়ম হলো সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। সাহল রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যত দিন পর্যন্ত মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে তত দিন পর্যন্ত কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। (বুখারি, মুসলিম)। এখানে তাড়াতাড়ি বলতে সূর্যাস্তের পরপরই বুঝানো হয়েছে। অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত আছে, রাসূল সা: বলেছেন, দ্বীন বিজয়ী থাকবে তত দিন যত দিন পর্যন্ত মানুষ ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। কারণ ইহুদি-নাসারারা ইফতার বিলম্বে করে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা)। আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, সেই বান্দা আমার নিকট বেশি প্রিয় যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে। অর্থাৎ সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ইফতার করে। (তিরমিজি)। আবু আতিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ও মাসরুক একদিন আয়েশা রা:-এর নিকট গেলাম এবং বললাম, হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ সা:-এর দু’জন সাহাবি রয়েছেন, তাদের একজন তাড়াতাড়ি ইফতার করেন, তাড়াতাড়ি সালাত আদায় করেন। আর একজন দেরিতে ইফতার করেন, দেরিতে সালাত আদায় করেন। আয়েশা রা: জিজ্ঞেস করলেন কে তাড়াতাড়ি ইফতার করেন এবং তাড়াতাড়ি সালাত আদায় করেন? আমরা বললাম, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা:। আয়েশা রা: বললেন, রাসূলুল্লাহ সা: তা-ই করতেন। আর অপর ব্যক্তি যিনি ইফতার ও সালাত আদায়ে বিলম্বে করতেন, তিনি হলেন আবু মুসা রা:। (মুসলিম)। উপরিক্ত হাদিসগুলো দ্বারা প্রমাণিত হলো যে ইফতার সূর্য ডোবার পর পরই করা উত্তম। তবে কোনো কারণে যদি বিলম্ব হয়ে যায়, তাহলেও ইফতার করে নেবে।
ইফতার খেজুর দিয়ে করা উত্তম। যদি খেজুর না পাওয়া যায় তাহলে শুধু পানি দিয়ে ইফতার করা উত্তম। সালমান বিন আমের হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন ইফতার করবে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। কেননা খেজুর বরকতময়। যদি খেজুর না পাওয়া যায় তাহলে সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কেননা পানি পবিত্র জিনিস। (তিরমিজি, আবু দাউদ)। আনাস রা: হতে বর্ণিত, নবী করিম সা: সালাতের আগে কিছু তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না পেতেন, তাহলে শুকনা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি শুকনা খেজুরও না পেতেন, তাহলে কয়েক চুমুক পানি পান করে ইফতার করতেন। (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
ইফতারের উপকারিতা- ১. আল্লাহর নির্দেশ পালন। কেননা আল্লাহ আদেশ করেছেন- অতঃপর রোজা পালন করো রাত পর্যন্ত। (বাকারা-১৮৭)। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই রাত শুরু হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন ওদিক (পূর্ব দিক) থেকে রাত নেমে আসে, আর এদিক (পশ্চিম) থেকে দিন চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়; তখনই রোজাদার ইফতার করবে। (বুখারি, মুসলিম)। অতএব সূর্য ডোবার সাথে সাথে ইফতার করার মাধ্যমেই আল্লাহর এই নির্দেশকে যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব। ২. রাসূলুল্লাহ সা:-এর পূর্ণ আনুগত্য লাভ। কেননা রাসূলুল্লাহ সা: ইফতার তাড়াতাড়ি করতে বলেছেন এবং নিজেও ইফতার তাড়াতাড়ি করেছেন। ৩. ইহুদি-খ্রিষ্টানের বিরোধিতা করা। কেননা তারা অন্ধকার হওয়ার পর ইফতার করে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা করো। তিনি আরো বলেছেন- যে ব্যক্তি যে জাতির সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করবে, সে জাতি তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। ৪. আল্লাহর প্রিয় বলে গণ্য হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি ইফতার করে সে ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করবেন। ৫. আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের সুযোগ লাভ করা। সারা দিন না খেয়ে থাকার পর ইফতারের মাধ্যমে আল্লাহ খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন, তাই তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। ৬. কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। কেননা রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, উম্মত কল্যাণ লাভে সমর্থ হবে যতক্ষণ তারা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। ৭. ইফতারের মাধ্যমে দোয়া কবুলের সুযোগ লাভ করা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ইফতারের আগে রোজাদারের দোয়া কবুল হয়। ৭. ইফতারের মাধ্যমে রোজাদার আনন্দ লাভ করার সুযোগ পায়। ৮. দ্বীন সহজ বলে প্রমাণিত হওয়া। আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কঠিন তা চান না। (সূরা বাকারাহ-১৮৫)। আল্লাহ ইচ্ছা করলে রোজাকে একাধারে রাখা বাধ্যতামূলক করতে পারতেন, যেমন সাওমে বিছাল, কিন্তু আল্লাহ ইফতার করার সুযোগ করে দিয়ে আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং সহজ করে দিয়েছেন। ৯. বান্দাহ যে আল্লাহর হুকুম পালনে তৎপর, তাড়াতাড়ি ইফতার করার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয় এবং বান্দাহর বন্দেগি প্রকাশ পায়। ১০. ইফতার করার পর সালাত আদায় করলে প্রশান্তির সাথে সালাত আদায় করা যায়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, খাবার মিশ্রিত সালাতের চেয়ে সালাত মিশ্রিত খাবার অনেক উত্তম। (তিরমিজি)। ১১. খেজুর দ্বারা ইফতার শুরু করলে স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর হয়। এতে পাকস্থলী ভালো থাকে এবং শরীরে শক্তি সঞ্চয় হয়। ১২. অন্য রোজাদারকে ইফতার করালে, রোজাদার ব্যক্তি রোজা রেখে যে পরিমাণ সাওয়াব পান, যিনি ইফতার করাবেন, তিনি তার সমপরিমাণ সওয়াব পাবেন, এতে কারো সাওয়াবে কোনো কমতি হবে না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে এ মাসে ইফতার করাবে, এ ইফতার তার গুনাহের মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে। আর তার সাওয়াব হবে রোজাদারের সমপরিমাণ অথচ রোজাদারের সাওয়াব একটুও কমিয়ে দেয়া হবে না।
Leave a Reply