আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ বছর ঘুরে আমাদের মাঝে শান্তির পয়গাম, পুণ্যের আহ্বান, জান্নাতের হাতছানি, বরকতের সওগাত, রহমতের আশ্বাস, মুক্তির প্রতিশ্র“তি, বদরের গৌরব কদরের সম্মান সর্বময় কল্যাণ নিয়ে সমুপস্থিত মহীয়ান মাহে রমজান; মুমিনের প্রতীক্ষিত ও কাঙ্খিত মাস রমজানুল মোবারক। প্রতিবারের ন্যায় এবারো ‘রমজানুল মোবারক’ শিরোনামে আমাদের ধারাবাহিক লেখার আয়োজন থাকবে। পাঠক আশা করি আপনারা আমাদের ‘রমজানুল মোবারক’ প্রতিদিনের লেখাটি পাঠ করবেন এবং তাতে রমজান বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন তথ্য জানতে পারবেন।
রোজা মুসলমানদের কাছে বহুল পরিচিত ও পালনীয় ফরজ ইবাদত। এ সময় মুসলিম উম্মাহ পুরো এক মাস রোজা পালন করে। রমজান হিজরি সালের নবম মাস। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। রমজান শব্দটি আরবি ‘রমজ’ থেকে এসেছে। ‘রমজ’ অর্থ দহন বা পোড়ানো। এ মাসে রোজা পালন করলে মানুষের মধ্য থেকে লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হয়। আগুন যেমন কোনো জিনিসকে পুড়িয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি রোজাও মানুষের অসৎ কাজকে পুড়িয়ে ফেলে। রোজা পালনকারী রমজানে তার সব পাপ মুছে ফেলার সুযোগ লাভ করে। এ অর্থে রোজার মাসকে মাহে রমজান বলা হয়। রোজা ফারসি শব্দ, এর অর্থ উপবাস। আরবিতে রোজাকে বলা হয় সওম। সওমের বহুবচন সিয়াম, এর অর্থ বিরত থাকা। তাই শরিয়তের পরিভাষায় রোজা বলতে বোঝায়- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সহবাসসহ আল্লাহর নিষিদ্ধ সব কাজ থেকে বিরত থাকা। রোজা শুধু হজরত মুহাম্মদ সা:-এর উম্মত মুসলমানদের ওপরই ফরজ করা হয়নি, এর আগেও রোজা পালনের বিধান ছিল। পৃথিবীতে প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা নবী হজরত আদম আ:, তিনিও রোজা পালন করতেন। হজরত নূহ আ:-এর সময় প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল। হজরত দাউদ আ: তার শিশুপুত্রের অসুস্থতার সময় সাত দিন রোজা পালন করেছেন বলে জানা যায়। হজরত মূসা আ: ও ঈসা আ: ৪০ দিন করে রোজা রেখেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মহররমের নবম ও দশম তারিখে রোজা রাখতেন। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষ (৬২৩ ঈসায়ী) রোজাকে ফরজ করে আল্লাহপাক কোরআনের আয়াত নাজিল করেন। ‘রমজান মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি সঠিক পথের সন্ধানদাতা, চলার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলি, হক ও বাতিলকে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনকারী। এখন থেকে তোমাদের মধ্যে যে এ মাসটি পাবে সে পুরো মাস ধরে রোজা রাখবে। যে ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে যায় বা সফরে (ভ্রমণে) থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোজার মাসের পরে অবশিষ্ট রোজার সংখ্যা পূর্ণ করে নেয়। আল্লাহ তোমাদের সাথে কোমল নীতি অবলম্বন করতে চান, কঠোর নীতি অবলম্বন করতে চান না।’ – আল বাকারা। আর রমজান মাসের একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরজের শামিল, একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজের শামিল। তাই আমাদের এই বরকতময় ও কল্যাণময় মাসকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা জানি সেনাবাহিনীতে কেউ যোগ দিলে প্রথমে তাকে ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আর রমজানের রোজাও মুসলমানদের জন্য ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ স্বরূপ। এ মাসের রোজা রাখার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেহরি ও ইফতার করতে হয়। সারা দিন প্রচন্ড গরমের মধ্যে না খেয়ে ও পানাহার না করে গরিবরা কী ধরনের কষ্ট অনুভব করে, তা অনুভব করিয়ে দেয় রোজা। আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা রোজার মাধ্যমে পাওয়া যায়। যেমন অন্যান্য ইবাদতে মানুষকে দেখানো ‘রিয়া’ অথবা কোনো সময় অহঙ্কার এসে যায়। কিন্তু রোজা একমাত্র আল্লাহর জন্য। কেননা গোপনে যদি কিছু খেয়ে নিই তা তো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখেন না। কিন্তু আমরা খাই না শুধু আল্লাহর ভালোবাসার টানে ও ভয়ে। জীবনকে কুরআনের আলোয় গড়তে আল্লাহ আমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন। হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ। ঢাল যেভাবে শক্রর আক্রমণ থেকে কোনো ব্যক্তিকে রক্ষা করে, অনুরূপ রোজাও ব্যক্তিকে শয়তানি হামলা থেকে রক্ষা করে। সুতরাং রোজাদার অশ্লীল কথা বলবে না ও জাহেলি আচরণ করবে না। কোনো লোক তার সাথে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে বা গালমন্দ করলে সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’ রাসূল সা: এ কথা দুইবার বলেছেন, ‘ওই স্বত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশক আম্বরের চেয়েও অতীব সুগন্ধময়। কেননা রোজাদার কেবল আমার সন্তুষ্টির জন্যই দিনের বেলা পানাহার ও অন্যান্য বিষয় ত্যাগ করে। রোজা আমার জন্য এবং আমি বিশেষভাবে রোজার পুরস্কার প্রদান করব। আর নেক কাজের পুরস্কার ১০ গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে। তাই রোজার ১০ গুণ পুরস্কার দেয়া হবে।’ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রমজানের মাস উপস্থিত হলে রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে এবং শয়তানগুলোকে আবদ্ধ করা হয়।’ রোজার মাধ্যমে আমরা অন্যায়, গুনাহ ও পাপাচার থেকে মুক্ত থাকতে পারি। কেননা এ মাসে শয়তানদের আবদ্ধ রাখা হয়। কিন্তু শয়তানের অনুসারী খারাপ মানুষদের তো বেঁধে রাখা হয় না, তাই তাদের থেকে বাঁচার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা ও অশালীন আচরণ থেকে বিরত থাকল না তার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়াতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
Leave a Reply