আ,ফ,ম নুরুল কাদের ॥ সদকাতুল ফিতর ইসলামী পরিভাষা। দু’টি শব্দের সমষ্টি তথা ‘সদকাহ’ ও ‘আল-ফিতর’। ‘সদকাহ’ অর্থাৎ দান, যা একজন অধিক সামর্থ্যবান ব্যক্তি কোনো অভাবী দরিদ্রকে প্রদান করে থাকেন। ‘আল-ফিতর’ অর্থাৎ রোজা ভঙ্গ করা। অতএব, এর অর্থ দাঁড়ায়; এটা এমন এক সদকাহ যা একজন রোজাদার রমজান মাসে সিয়ামের নির্দেশ পালন করার পর ১ শাওয়াল যেদিন প্রথম রোজা রাখা বন্ধ করবেন সেদিন যে সদকাহ দিয়ে থাকেন তাই সদকাতুল ফিতর। আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশে পুণ্যের উদ্দেশ্যে যে বাধ্যতামূলক বা ঐচ্ছিক ‘দান’ সম্পাদন করা হয়, তা-ই সদকাহ। এখানে এ সদকাহ যেহেতু রাসূল করিমের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সম্পাদিত হয় তাই ওয়াজিব। সদকাতুল ফিতরকে হাদিস শরিফে জাকাতুল ফিতর নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এ সদকাহটি আমাদের দেশে ‘ফিতরা’ নামে অভিহিত। ইমাম নাওয়াভি এ পরিভাষাটির উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, এটি মূলত আরবি পরিভাষা না হলেও ফোকাহাদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন, একে ‘জাকাত’ ও ‘সালাত’-এর অনুরূপ একটি স্বতন্ত্র পরিভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ‘সদকাতুল ফিতর’-এর যৌক্তিকতা : এ সদকাহর প্রধান কারণ হচ্ছে ঈদের দিনে ফকির-মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং তাদের ঈদের আনন্দে শরিক করা। যাতে করে এ উৎসবের দিনে খাবারের জন্য তাদের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগতে না হয়। এর আরো একটি উদ্দেশ্য হলোÑ রমজানের রোজা রাখতে গিয়ে আমাদের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেল তার প্রতিবিধান। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাস রা: বর্ণিত হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি বলেছেন, রাসূল সা: জাকাতুল ফিতর বাধ্যতামূলক করেছেন। সদকাতুল ফিতর’ কার ওপর ওয়াজিব এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার এখানে সুযোগ নেই। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বলা যায়, প্রত্যেক স্বাধীন মুসলিম নর-নারী যিনি ঈদের দিনে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী তার ওপর বাধ্যতামূলক। তিনি নিজের পক্ষে, তার স্ত্রী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্তানাদিদের পক্ষে এ সদকাহ আদায় করবেন। ইমামদের অনেকেই নিসাবের অধিকারী হওয়ার শর্ত করেননি। তাদের মতে, যদি কেউ সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে তাকেও এ সদকাহ আদায় করতে হবে। চাই তিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী না হবেন। ‘সদকাতুল ফিতর’-এর পরিমাণ প্রসঙ্গ : ‘সদকাতুল ফিতর’-এর পরিমাণ সংক্রান্ত বিষয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে নিম্নোক্ত হাদিসগুলোর উল্লেখ করা যায় : ১. হজরত ইবনে উমর রা: বর্ণিত হাদিস; তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: (মুসলিম) জনতার ওপর ‘সদকাতুল ফিতর’ বাধ্যতামূলক করেছেন, (যার পরিমাণ হলো) এক সা খেজুর অথবা এক সা জব। এটা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক স্বাধীন মুসলিম অথবা দাসের ওপর প্রযোজ্য। বুখারি (৩/৩৬৭), মুসলিম (২/৬৭৭)। পর্যালোচনা : গরিবদের স্বার্থ সংরক্ষণের খাতিরে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ পলিসি গ্রহণ বাঞ্ছনীয়Ñ ক. ধনীদের জন্য এসব বস্তুর মধ্যে যার মূল্য সর্বোচ্চ তার এক সা পরিমাণ। যেমনÑ কিশমিশ। খ. উচ্চ-মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্তুর মূল্য মাঝামাঝি তার এক সা পরিমাণ। যেমনÑ খেজুর। গ. নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্তুর মূল্য সর্বনিম্ন তার এক সা পরিমাণ। যেমনÑ গম বা জব হবে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণের ভিত্তি। সদকাতুল ফিতরের নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপরি উক্ত নীতিমালা অবলম্বনই শরিয়াহর মূল স্পিরিটের সাথে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করি। কারণ একজন ব্যক্তি যিনি কোটি টাকার মালিক এবং হয়তো লক্ষাধিক টাকা জাকাত বাবদ আদায় করে থাকেন, তার উচিত হবে না সর্বনিম্ন বস্তুর দামে সদকাতুল ফিতর আদায় করা। পক্ষান্তরে একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত যিনি ঐচ্ছিকভাবেই সদকাতুল ফিতর আদায় করছেন তাকেও সর্বোচ্চ মূল্যের বস্তুর বাজার দরে সদকা দিতে বাধ্য করাও সমীচীন হবে না। আধুনিক যুগের প্রখ্যাত ফকিহ সাইয়িদ সাবিক সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, সদকাতুল ফিতরের ওয়াজিব পরিমাণ হচ্ছে এক সা গম অথবা জব অথবা খেজুর অথবা কিশমিশ অথবা পনির অথবা চাল অথবা ভুট্টা ইত্যাদি। (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৬৪)। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে বরং এক সা পরিমাণ খেজুর বা কিসমিসের মূল্যই কমপে দুই সা পরিমাণ গমের মূল্যের চেয়েও অধিক। অতএব অর্ধ সা পরিমাণ গমকে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হিসেবে চিহ্নিত করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হবে না বরং উপরিউক্ত দ্রব্যগুলোর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে এক সা হবে স্ট্যান্ডার্ড। তা ছাড়া এগুলোর কোনটিকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হবে তা নির্ধারিত হবে দাতার সামর্থ্যরে বিচারে। প্রসঙ্গত এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা সমীচীন মনে করি, হজরত আবু সাইদ খুদরি বর্ণিত হাদিসে ‘অথবা এক সা পরিমাণ খাবার’ এর আলোকে আমাদের দেশের জন্য গম, খেজুর, জব বা কিসমিসের বিকল্প হিসেবে এক সা পরিমাণ (৩.৩ কেজি) চাল অথবা এর দামও সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতদ সংক্রান্ত বিষয়ে উল্লিখিত হাদিসগুলো ও ইসলামের স্পিরিট অনুযায়ী আমাদের দেশের বাজার দরের আলোকে সদকাতুল ফিতরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হবে এক সা গমের দাম যা নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য প্রযোজ্য। মধ্যম নিসাব হবে এক সা খেজুরের দাম বা ২০০ থেকে ৪০০ টাকা যা উচ্চ-মধ্যবিত্তের জন্য প্রযোজ্য এবং উচ্চতর নিসাব হবে ৫০০ থেকে ৬৬০ টাকা যা উচ্চবিত্তদের জন্য প্রযোজ্য। এখানে আরো উল্লেখ্য, বাজারে যেসব দ্রব্যের মান ও মূল্যমানে অনেক তফাত বিদ্যমান তার কোনটিকে ভিত্তি করা হবে তা-ও নির্ধারিত হবে দাতার ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহারের অগ্রাধিকারের আলোকে। যেমন কেউ ব্যক্তি পর্যায়ে ২০০ টাকা দামের কিসমিস ব্যবহার করলে তিনি ২০০ টাকা হিসেবে এক সা কিসমিসের দাম দেবেন ৬৬০ টাকা। অন্যজন ৬০ টাকা দামের খেজুর ব্যবহার করলে তিনি ৬০ হিসেবে এক সা খেজুরকে ভিত্তি ধরবেন। চালের ক্ষেত্রেও অভিন্ন পলিসি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এবার কুষ্টিয়ায় ফেতরা ধরা হয়েছে টাকা। ইসলামী ফাউন্ডেশন কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয় থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। আল্লাহপাক আমাদের ফিতরাহ তরতিবের সাথে আদায়ের তৌফিক দান করুন-আমিন