আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ রোজা শব্দটি ফারসি ভাষা হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। এ শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘সওম’। সওমের আভিধানিক অর্থ হলো ‘বিরত থাকা’ বা ‘বর্জন করা’। শরিয়াহর পরিভাষায় ‘সুবহে সাদেক’ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম ‘সওম’ বা ‘রোজা’। রোজা ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। নামাজের পরই এর স্থান। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ। এ প্রসঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন পবিত্র কুরআন শরিফে ঘোষণা করেছেন, ‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের ওপর সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হলো যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ -সূরা বাকারা : ১৮৩
রোজা যুগে যুগে : ঐতিহাসিকভাবে রোজার প্রচলন বহুযুগ আগে। এটি একটি প্রাচীন অনুশাসন। ইহুদি খ্রিষ্টানসহ প্রায় সব ঐশী ধর্মের অনুসারীদের ওপরই রোজা পালনের আদেশ কার্যকর ছিল। আল্লামা আলোসির মতে, হজরত আদমের (আ:) যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত তাফসিরকারক মাহমুদুল হাসান (রহ:) বলেছেন, ‘রোজার হুকুম হজরত আদম (আ:) থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।’ আল্লামা ইবনে কাছির তার বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হজরত নূহের (আ:) যুগ থেকে প্রত্যেক মাসে তিনটি রোজা রাখার হুকুম ছিল এবং তা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বহাল ছিল। হজরত দাউদ (আ:) তার শিশুপুত্রের অসুস্থতার সময় সাত দিন রোজা রেখেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। হজরত মূসা (আ:) চল্লিশ দিন রোজা রাখতেন এবং মহররমের দশ তারিখেও তিনি রোজা রাখতেন। হজরত ঈসা (আ:) ও চল্লিশ দিন রোজা রাখতেন এবং তার অনুসারীদের রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্মে রোজা পালনের প্রচলন ছিল। তবে তার ধরন ও পরিপালন পদ্ধতি ছিল আলাদা। প্রাচীন চীনা সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ একটানা রোজা রাখার নিয়ম প্রচলিত ছিল। পারসিক অগ্নিপূজক, খ্রিষ্টান পাদ্রী এবং হিন্দু যোগীরাও রোজা পালন করতেন। ইসলামে রোজার প্রবর্তন : ইসলাম শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। রোজার বর্তমান বিধানও তখন থেকে শুরু হয়। ইসলামে রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে মহানবী (সা:) মহররমের দশ তারিখে রোজা রাখতেন। তখন তিনি ইহুদিদের রীতি অনুযায়ী রোজা পালন করতেন। নবী করিম (সা:) ইহুদিদের থেকে আলাদা হতে চাইলেন এবং এজন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়াও করলেন। মহানবীর (সা:) প্রার্থনা অনুযায়ী হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে অর্থাৎ ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রোজা ফরজ হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত নির্দেশ ছিল এ রকম : ‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের ওপর সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হলো যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ সূরা বাকারা : ১৮৩। আল্লামা হাফেজ ইবনুল ফাইয়িম (রহ:) বলেছেন, ‘রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ফরজ করা হয়নি। সাহাবারা তাওহিদ, নামাজের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করার পরই রোজার বিধান তাদের ওপর প্রবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআনে রোজার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য স¤পর্কে বলা হয়েছে : ১. রমজান মাস হলো সেই মাস যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের হেদায়াত ও সত্য পথযাত্রীদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসে রোজা রাখবে। -সূরা আল বাকারা : ১৮৫ । ২. তোমরা খাও এবং পান করো তখন পর্যন্ত যখন তোমাদের সামনে সুবহে সাদিকের আলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে কাল রেখা থেকে। অতঃপর সুবহে সাদিক থেকে রাত আসা পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। -সূরা আল-বাকারা : ১৮৭ । ৩. নবী করিম (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে এবং এমনিভাবে রাতে ইবাদত করে তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। -বুখারি। ৪. রাসূল করিম (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোজা রাখবে আল্লাহ তাকে দোজখ থেকে সত্তর বছরের দূরে রাখবেন। -বুখারি। রোজার ফজিলত : রোজার ফজিলত অফুরন্ত। রোজা মানুষকে পূতপবিত্র করে এবং তার গুনাহ খাতাকে নির্মূল করে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন বলেন, ‘ রোজা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো’। দুনিয়ার পুণ্যের কাজের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার এবং প্রতিদানের কথা রয়েছে। কিন্তু রোজার যে নিয়ামত ও প্রতিদান তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। অতএব, দেখা যায় রমজানের রোজা মুসলমানদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের মাস। আত্মার উন্নতি, ইহলৌকিক কল্যাণ এবং পারলৌকিক মুক্তির জন্য রোজা মুসলিম জীবনে আসে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে।
Leave a Reply