কৃষি প্রতিবেদক \ রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে-কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈবসার ও জৈব কীটনাশক দিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করাই অরগ্যানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি। অরগ্যানিক ফুড বা জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কারণ রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফসল উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈবসার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশসম্মত ও উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য হয় স্বাস্থ্যসম্মত। বাংলাদেশে শাকসবজি উৎপাদনে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় ইউরোপের দেশগুলো এদেশ থেকে শাকসবজি ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে। ‘বিশ্ব জৈব কৃষি ২০১৮ : পরিসংখ্যান ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অরগ্যানিক চাষাবাদ পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর তথ্য রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে এখন ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টরে অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট জমির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এশিয়া মহাদেশে সার্বিক অরগ্যানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন। আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে তলানিতে। অরগ্যানিক চাষাবাদে শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে বেশ এগিয়ে।
নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা ও চাষাবাদ বাড়ছে
বিশ্বব্যাপী এই নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে চাষাবাদও। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষিনির্ভর দেশ হয়েও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এখনো বিশ্বের যেসব দেশে মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র এক শতাংশ জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হয়, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানও রয়েছে। তাও আবার অনেক দেশের পেছনে। বাংলাদেশে মাত্র ৮ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন হয়। স¤প্রতি ‘বিশ্ব জৈব কৃষি ২০২১ : পরিসংখ্যান ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাবিশ্বে এখন ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট জমির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এশিয়া মহাদেশে সার্বিক অরগ্যানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। অরগ্যানিক চাষাবাদে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান।
বিশ্বের ১৭৯টি দেশে অরগ্যানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করা হচ্ছে। বিশ্বের ২৪ লাখ কৃষক এখন প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষক রয়েছে ভারতে ৫ লাখ ৮৫ হাজার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় অরগ্যানিক কৃষিপণ্য উৎপাদনকারীর সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ৬০২। ২ লাখ কৃষক নিয়ে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। অন্যদিকে জমি আবাদের দিক থেকে শীর্ষ তিনে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ২ কোটি ২৭ লাখ হেক্টর, আর্জেন্টিনায় ৩১ লাখ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক কৃষিপণ্য আবাদ হচ্ছে। ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে অরগ্যানিক কৃষি পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অরগ্যানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। আগামী কয়েক বছরে এটি ১৩৮ বিলিয়র ডলারে দাঁড়াবে। ১৬৪ দেশে বর্তমানে সার্টিফাইড অরগ্যানিক পণ্য সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করছে। এর বেশির ভাগ দেশই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত। তাই একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
অরগ্যানিক চাষে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ। মোট অরগ্যানিক চাষের ২৫ শতাংশ হয় এই মহাদেশে। ৯৩ লাখ হেক্টর জমির এই চাষাবাদে আড়াই লাখেরও বেশি খামার জড়িত। আফ্রিকায় ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয় এবং প্রায় ৫ লাখ কৃষক এর সাথে জড়িত।
বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম কার্যক্রম’ জৈব কৃষির বিস্তারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ ‘আইপিএম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের খেতের পোকা দমন করা হয়, যাতে করে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর কৃষকের নির্ভরতা কমে আসে। ‘আইপিএম পদ্ধতির’ বা ‘সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার’ মাধ্যমে বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উপকারী বন্ধু পোকার লালন ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা। জৈব কৃষিতে উৎপন্ন শাকসবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রপ্তানির কার্যক্রম আমাদের কৃষিকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারে, বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশে চলছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সহযোগিতামূলক গবেষণা সহায়তাকারী কার্যক্রম। বাংলাদেশের বিএআরসি, বারি, ব্রি, বিজেআরআই, বিএসআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। জানা গেছে, ২০০৫ সালের গোড়ার দিকে ‘উজবেকিস্তান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ কৃষিবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের কয়েকজন কৃষিবিদের কাছে ‘উপকারী বন্ধু পোকার’ বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হস্তান্তর করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কিছু পোকার সেক্স ফেরোমন উৎপাদন কৌশল হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। তখন থেকেই যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উপকারী বন্ধু পোকা ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ উৎপাদন। সফল গবেষণার পর কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম’ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ফসল উৎপাদন এলাকায় উপকারী বন্ধু পোকা ওপোকার সেক্স ফেরোমন কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষকরা সানন্দে এগুলো গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও জৈব কৃষি দ্রুত প্রসার লাভ করছে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), উবিনীগ, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, শিসউক ও বিসেফ ফাউন্ডেশন এই পাঁচ সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ ফুড সেফটি নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন)। এই নেটওয়ার্ক জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় ২০১০ সালে গঠিত হয়। বর্তমানে এফএওর কারিগরি সহযোগিতায় ও বাংলাদেশ সরকার ও নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় দেশব্যাপী নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জৈব কৃষি আন্দোলন অন্যতম।
লেখক ঃ এস এম মুকুল, কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
Leave a Reply