ঢাকা অফিস ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) আগুন লেগে অন্তত ৫২ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর ছাদ থেতে লাফিয়ে পড়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়। আর শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ৪৯ জনের মরদেহ পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়। এসব মরদেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এজন্য নিহতদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করছে সিআইডির ফরেনসিক টিম। এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম ব্যাপারীকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানা যায়, ওই ভবনে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। করোনার কারণে কারখানার কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। কারখানার স্টোরেজ, কার্টন ও ফুড সেকশন ছয় তলায়। সেখানে চার শতাধিক শ্রমিক কাজ করছিলেন। শতাধিক শ্রমিক দোতলায় ফুড প্যাকেজিংয়ে কাজ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তৃতীয় তলার কার্টন সেকশন থেকে লাগা আগুন মুহূর্তে দোতলার টোস্ট সেকশন, তৃতীয় তলার লাচ্ছি ও লিচু সেকশন, ৪ ও ৫ তলার স্টোর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। লকাডাউনের কারণে কারখানা আংশিক চলমান ছিলো। সে কারণে ঘটনার দিন কর্মরত ছিল তিন হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। তারা সবাই নি¤œ আয়ের মানুষ। স্বজনরা জানিয়েছেন, এখানে কর্মরত শ্রমিকদের আয়ে চলে তাদের সংসার। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার বিকালে আগুন লাগার পর ভবনের ছাদ থেকে এক এক করে লাফিয়ে শ্রমিকরা মাটিতে পড়েন। এ ঘটনায় অনেকের হাত-পা ভেঙ্গে গেছে। মাথায়, পিঠে মারাত্মক জখম হয়েছে। শ্রমিকদের খুজঁতে আসা স্বজনদের আর্তনাদে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে। নিদারুণ এক দৃশ্য। কেউ ছুটছেন স্বজনের খোঁজে। শোকে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কেউবা নিরবে দাঁড়িয়ে আছেন ভবনের পাশে। আবার কেউ কেউ মুর্ছা যাওয়া স্বজনদের পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বজনরা অভিযোগ করে জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আগুন লাগার পরও কর্তৃপক্ষ গেটের তালা না খোলায় বের হতে পারেননি শ্রমিকরা। ছাদে এবং বিভিন্ন ফ্লোরে গিয়ে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেন তারা। কিন্তু বের হতে না পেরে তাদের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, ওই ভবনের ছয়তলা ভবনে প্লাস্টিক, ফয়েল, কাগজ, কার্টন, রেজিন, ঘিসহ খাদ্য তৈরির বিভিন্ন মালামাল ও প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠে । এ কারণে আগুন দ্রুত অন্য ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি আগুন এক দফা নেভানোর পরও আবার জ্বলে উঠছিল। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মরদেহের অধিকাংশই পুড়ে গেছে। ওই কারখানার দু’টি ফ্লোরের পাঁচ ও ছয়তলায় আগুন ড্যাম্পিংয়ের কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস। ড্যাম্পিংয়ের কাজ শেষে সেখানে আরও মরদেহ রয়েছে কি-না, তা তল্লাশি করে দেখা হবে। তিনি বলেন, মরদেহগুলো উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে। পাঁচ ও ছয়তলায় তল্লাশি চালিয়ে পরে আপডেট তথ্য জানাতে পারবেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় অন্তত ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। ওই ভবন সেন্ট্রাল গোডাউন হিসেবে তারা ব্যবহার করতেন। ভবনে বিভিন্ন জুসের ফ্লেভার, রোল, ফয়েল প্যাকেটসহ বিভিন্ন মালামাল ছিল। আগুন লাগার পর কত শ্রমিক আটকা পড়েছেন, তা তারা জানেন না। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে দাবি তাদের। তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম ব্যাপারী বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনদেরকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এছাড়াও যারা আহত হয়েছেন তাদেরকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এদিকে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন, যে ৪৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্র“পের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরির ( সেজান জুসের কারখানা) নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে ভবনটি থেকে লাফিয়ে পড়েন শ্রমিক স্বপ্না রানী (৪৫) ও মিনা আক্তার (৩৩)। ঘটনাস্থলেই তাঁরা দুজন মারা যান। এরপর মোরসালিন (২৮) নামের একজন শ্রমিক প্রাণ বাঁচাতে ওই ভবনের তৃতীয় তলা থেকে লাফ দেন। মোরসালিনকে রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply