ঢাকা অফিস ॥ ‘লকডাউনের নামে সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকাসহ সাত জেলায় করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং সরকারের নেয়া পদক্ষেপের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে গত ২০ জুন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো মহাসচিব তুলে ধরেন। মির্জা ফখরুল বলেন, এটা (লকডাউন) ওয়ার্কেবল না কিন্তু। একটাও কাজ করে না। ঢাকাতেও লকডাউন আছে। আপনি লকডাউন কোথাও দেখতে পান? কোথায় লকডাউন? আমি তো দেখতে পাই না। যার যেখানে খুশি যাচ্ছে, যার যা খুশি করছে। আমি পরশুদিন দেখলাম, একটা হোটেলে বিয়েও হচ্ছে। অথচ দেয়ার ইজ ব্যান্ড। সরকার এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন এবং লকডাউন তাদের লোক দেখানো একটা ব্যাপার। এটা প্রতারণা মানুষের সঙ্গে যে, আমরা লকডাউন দিচ্ছি, চেষ্টা করছি। মির্জা ফখরুল বলেন, আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে, ‘ল অ্যান্ড ফোর্সেস এজেন্সিজ, যাদের এই লকডাউন ইমপ্লিমেন্ট করার কথা তাদেরকেও দেখা যায় না আজকাল। দে আর নট ভিজিবল, তারা ভিজিবল না এখন। দেখলাম, পত্রিকায় একজন কনস্টেবল মারা গেছেন, তার ছবি দিয়ে বিরাট করে ছাপা হয়েছে। আর এদিকে শত শত লোক মারা যাচ্ছে তাদের কোনো কথা নেই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, আর বলতে চাই না। বিশেষ প্রাণী পানি খায়, ঘোলা করে খায় আরকি। আমরা বহু আগেও তাদেরকে (সরকার) বারবার সুনির্দিষ্টভাবে বলেছি, করোনা মোকাবিলায় এসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তারা নেননি। বহুদিন পরে তারা এখন এসব ব্যবস্থা (লকডাউন) নিচ্ছেন। এখন বলে বলে আর বলতে ইচ্ছে করে না। কী বলবেন, এদের তো চামড়া মোটা। এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কবেই পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তিন করেননি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উল্টো তারা সবাই সবাইকে ডিফেন্ড করছে। খুব ভালো কাজ করছে। এত ভালো স্বাস্থ্যমন্ত্রী না কি আর হয় না। মির্জা ফখরুল বলেন, সভায় অবিলম্বে টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়। সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, জনগণ তা জানতে চায়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসক বোর্ডের প্রধান ডা. এএফএম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া করোনা মুক্ত হলেও করোনা পরবর্তী কয়েকটি জটিলতায় ভুগছেন এবং তিনি কোনোমতেই ঝুঁকিমুক্ত নন। তার লিভার ও অন্যান্য জটিলতার চিকিৎসা বিদেশে কোনো উন্নত কেন্দ্রে প্রয়োজন। বাংলাদেশে যার কোনো সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। ফখরুল বলেন, ‘স্থায়ী কমিটি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আরও উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রেরণের জন্য তার বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি তার মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে। গত ২০ জুন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ফুসফুসসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। খালেদা জিয়াকে বিদেশে প্রেরণে দলের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আগে বলিনি, ওনার পরিবার বিদেশে প্রেরণ কথা বলেছিল। আমরা এবার পার্টির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রেজুলেশন নিচ্ছি যে, তার বিদেশে চিকিৎসা দরকার। এর জন্য যা কিছু সরকারের করা দরকার সরকারের করা উচিত ইমিডিয়েটলি। তার পরের যে স্টেপগুলো আছে পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ৫৩ দিন চিকিৎসা শেষে গত ১৯ জুন খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসায় ফিরেছেন। হাসপাতালে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকার কারণে তাকে বাসায় নিয়ে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয় ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। গত ১৪ এপ্রিল গুলশানের বাসায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানেই তিনি চিকিৎসা নেন। পরে পোস্ট কোভিড জটিলতা নিয়ে গত ২৭ এপ্রিল তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম কয়েকদিন কেবিনে চিকিৎসাধীন থাকলেও ফুসফুসের জটিলতা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে এক মাস ছিলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেয়াকে দুরভিসন্ধিমূলক। তিনি বলেন, এনআইডি প্রকল্পের বিষয়ে ইসি চিঠি দেয়ার পরও দুই লাইনের একটা চিঠি দিয়ে সরকার সরাসরি নাকচ করে। এটা একটা অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েও তারা (সরকার) একটা চক্রান্ত, একটা ষড়যন্ত্র করতে যাচ্ছে, যাতে তারা জনগণের পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা এহেন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাচ্ছি। সরকারকে তার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহবান জানাচ্ছি। বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, এটা সত্যি কথা যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যাপারটা তাদের হাতেই থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে আওয়ামী লীগের সরকার যারা আছে, তারা এটা পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করবে বলে সবাই বিশ্বাস করে। এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা শুধু বিএনপির কথা নয়, নির্বাচন কর্মকা-সহ অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত, এনজিও যারা আছেন তারা সবাই বলছেন যে, এটা কোনো মতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাওয়া উচিত নয়। তাহলে সরাসরি সরকারের হাতে পড়ে যাবে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আঙ্কটার্ডের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এখানে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১১ শতাংশ কমে গেছে। এখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ করার কোনো পরিবেশ নেই। কেন নেই? এখানে যে দুঃশাসন, গর্ভানেন্সের যে অভাব, দুর্নীতি এবং সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে এখানে যখন কেউ বিনিয়োগ করতে যায়, তখন তাকে কেঁদে কেঁদে সব ফেলে দিয়ে যেতে হয়। তারপরে কনট্রাকশন করতে গেলে চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন, অথচ সরকারের ঢোল বাজছে সব সময় যে, এখানে উন্নয়ন উন্নয়ন হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নটা কোথায়? কয়েকটা ব্রিজ তৈরি করা, কয়েকটা উড়াল সেতু তৈরি করা এগুলোকে উন্নয়ন বলব না-কি? উন্নয়নটা সেটা যেটাতে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, অভাব কমে। যেখানে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে গেছে দুই কোটি, সেখানে কোন যুক্তিতে উন্নয়ন বলতে পারি। করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা উল্লেখ করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, অবিলম্বে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া উচিত। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদলের সাবেক নেতা সাইফুল ইসলামের পায়ে গুলি এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে তাদের মুক্তি দাবি করেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর।