বিশেষ প্রতিনিধি ॥ লকডাউনের কারণে কুষ্টিয়ায় ৩০ হাজারের অধিক দৈনিক হাজিরার শ্রমিকসহ কর্মহীন প্রায় অর্ধলক্ষ কর্মজীবি মানুষের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই অনাহারে থাকলেও তাদের খোজ নেওয়ার কেউ নেই। সেই সাথে এইসব শ্রমিক ও কর্মজীবি মানুষদের পরিবারের অসুস্থ্য সদস্যদের কেউ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হলেও তা নজরে আসছে না কারো। কঠোর লকডাউনের তৃতীয় দিনে এইসব ভুক্তোভোগী পরিবারের অনেক সদস্য অভিযোগ করে জানান, আমরা করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের করুণ অবস্থার কথা কেউ শোনে না এইটাই দুঃখের বিষয়। গত দুই দিনে জেলার সর্ববৃহৎ শ্রমিকের প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়ার বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী, বিআরবি ক্যাবল গ্রপ, দুইটি প¬াইউড কারখানার শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার দিন হাজিরার মানুষদের সাথে কথা বলে এমন করুন তথ্য জানা গেছে। তারা অভিযোগ করেছেন মহামারী করোনা নিয়ন্ত্রনে আসুক আমরা সেটাই চাই। সেই সাথে আমাদের জন্য নূন্যতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। অভিযোগকারীরা জানান, করোনার প্রথম ঢেউ দেশব্যাপী শুরু হওয়ার পর লকডাউন সহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো এই কুষ্টিয়াতেও। কিন্তু সেই সাথে দিনমজুরদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছিলো। ফলে আমরা শ্রমজীবি মানুষ এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা তখন প্রশাসনের নির্দেশের প্রয়োজন মনে করি নাই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা আমাদেরই স্বার্থেই প্রয়োজন, সেটাই করেছি। কিন্তু এবারের চিত্র আলাদা। আমাদের জন্য বেঁচে থাকার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। এমনকি আমরা জানি না আগামী দিনগুলি আমাদের জন্য আরো কতো কঠিন অবস্থা আসতে পারে। লকডাউন দেওয়া সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষ থেকে যেমন কোন সহযোগিতা করা হয়নি বা আগামীতেও করা হবে কি না তা আমরা জানিনা। তাই দিন শেষে রাতে যখন আমাদের পরিবারের ছোট্ট শিশুরা বা অসুস্থ্য ব্যক্তিগণ জানতে চাই আজ রাতে তো না খেয়ে থাকছি, আগামীকাল কি খাবার পাবো? অসুস্থ্য রোগি যখন প্রশ্ন করে আজতো ওষুধ না খেয়েই ঘুমাচ্ছি, কালকে কি আমার জন্য ওষুধ আনা হবে?। তখন আমরা নিরবে চোখের পানি ছাড়া কোন উত্তর দিতে পারছি না। কিন্তু কেনো এই দুরঅবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা স্বল্প শিক্ষিত মানুষরা সব খবর না রাখলেও মিডিয়ার এই যুগে কোন খবরই যে রাখিনা তা কিন্তু ঠিক নয়। আমরা প্রিন্ট এবং সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছিলাম কুষ্টিয়ায় করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবার পূর্বেই চিকিৎসক সহ জেলার গণমাধ্যমকর্মীরা দাবী জানিয়েছিলো এখনই কঠোর লকডাউন দেওয়া হোক। আজ থেকে এক মাস পূর্বে এই দাবী মেনে নেওয়া হয়নি। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এবং জেলার গণমাধ্যমকর্মীরা যেদিন লকডাউনের দাবী জানিয়েছিলো সেদিন কিন্তু লকডাউন দেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও করোনা নিয়ন্ত্রনে যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু কুষ্টিয়ায় ছিলো তা উপেক্ষিত। কার কারণে বা কাদের দাবীর প্রেক্ষিতে সেসময় লকডাউন দেওয়া হয়নি, তা আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে বা করোনা নিয়ন্ত্রনে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কাছ থেকে এই ব্যাপারে কোন কিছু না জানলেও মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জেনেছিলাম যে, কপিয় ব্যবসায়ী নেতা দাবী করেছে তারা শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করবেন। তাই তখন নাকি লকডাউন দেওয়া হয়নি। কিন্তু আদৌও কি কুষ্টিয়ায় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ী শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের কর্মকান্ড চালিয়েছেন? তার কৈফিয়ত চাওয়ার বোধ হয় কেউ নেই এ জেলায়। ক্ষুব্ধ এক মিডিয়াকর্মী তার ফেসবুক লিখেছে যে, যারা লকডাইন এর বিরোধিতা করেছিলো সেই সব ব্যবসায়ী নেতাদের একদিন করে কুষ্টিয়ার হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি দেওয়া হোক। এই খবর আমরা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জেনেছিলাম। সেসময় লকডাউনের বিরোধিতা করেছিল যে সব ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী নেতা তাদের কে এখন করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বপালন করতে পাঠানো হয়েছে কিনা তা আমরা জানিনা। সেই দায়িত্বপালন করতেও বোধ হয় কেউ যায়নি। তবে সেসময় যারা লকডাউনের কঠোর বিরোধিতা করেছিলো, তাদের আবার বর্তমানে দেখা যাচ্ছে লকডাউন কার্যকর করতে শহর ব্যাপী মাইকিং করছেন নিজেদের নাম দিয়ে। এমনকি যারা একসময় এই কুষ্টিয়া শহরে দোকান খোলার পক্ষে মহড়া দিয়েছেন তারাই আবার লকডাউন কার্যকর করতে যখন কোন জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা মাঠে নামছেন তখন ঐ সব সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী নেতারা তাদের সাথে উপস্থিত হয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছেন তা আমরা জানিনা। তবে গত ৪ দিনের কঠোর লকডাউনের পরেও করোনা পরিস্থিতি কুষ্টিয়ায় নিয়ন্ত্রনে আসেনি। এর কারণ হিসেবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, ক্ষতি যা হবার তা অনেক আগেই হয়েছে। এখন এই পরিস্থিতি উন্নতি কিভাবে হবে তা আমরা এই মুহুর্তে জানাতে পারছি না। তবে আজ পর্যন্ত কুষ্টিয়ার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি রোগির সংখ্যায় ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। সেই সাথে দীর্ঘমেয়াদি বা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে কর্মজীবি মানুষকে ঘরে আটকে রাখা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তখন হয়তো করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি কুষ্টিয়া সামাজিক পরিস্থিতিও অবনতির দিকে ধাবিত হতে পারে। এদিকে শ্রমজীবি মানুষদের পক্ষ থেকে দাবী জানানো হয়েছে, কুষ্টিয়ার বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী, বিআরবি ক্যাবল গ্রুপসহ দুইটি প¬াইউড কারখানার এবং অন্যান্য পেশার দিন মজুরির শ্রমিকদের যদি বেঁচে থাকার নূন্যতম ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে অনাহার ও বিনা চিকিৎসায় শত শত মানুষ মারা গেলেও অবাক হবার কিছু থাকবেনা। তাই আমাদের দাবী যেহেতু আমরা শত ভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইতিপূর্বে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেভাবে আমাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হোক অথবা আমাদের কর্ম বন্ধ থাকা অবস্থায় জীবিকার কি হবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক।
Leave a Reply