ঢাকা অফিস ॥ বিনিয়োগে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ দেশে শিল্প স্থাপনসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য সরকার দফায় দফায় বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। তাছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ঋণের সুদের হার কমিয়েছে। কিন্তু শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না দেয়ায় উদ্যোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না। আর চাহিদামতো ঋণ না পেয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প খাতের বিনিয়োগ। দেশের ৬৭টি তফসিলি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে ৬-৭টি সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া বাকি সবই বেসরকারি ব্যাংক। শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী গত মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ১১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। তার মধ্যে বেসরকারি শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার মতো। ওই ৩ লাখ কোটি টাকার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরই বেশির ভাগ অংশ। আর দীর্ঘমেয়াদি শিল্পঋণে ৬৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সম্মিলিত পরিমাণ তার চেয়ে কম। শিল্প বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সরকার বেসরকারি খাতে ব্যাংকের অনুমতি দিলেও সরকারের ওই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। বরং বেসরকারি ব্যাংকগুলো কিছু মালিকের সুবিধার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে এনজিওর মতো ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে অধিক মুনাফা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। অথচ বড় ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতেই সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। যা আগে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ছিল। ওই টাকা ব্যাংকগুলো অধিক মুনাফার ব্যবসায় লগ্নি করছে। কিন্তু তা দেশের শিল্প বিনিয়োগ উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সূত্র জানায়, করোনার চলমান প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফেরত আসছে। সরকার প্রবাস ফেরত ওই শ্রমিকদের পুনর্বাসনসহ নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এবং দেশকে উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার তাগিদে শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি ১০০টি ইকোনমিক জোন স্থাপনেরও অনুমতি দিয়েছে। ওসব ইকোনমিক জোনে শিল্প স্থাপন করতে গেলে উদ্যোক্তাদের ইকুইটির পাশাপাশি ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে যথেষ্ট অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। আর সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালীসহ ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রকল্প স্থাপনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কারণ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সিঙ্গল বরোয়ার এক্সপোজারে এসব ব্যাংকের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরকারি পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংক এগিয়ে না এলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কোনোভাবে সম্ভব হবে না এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নেয়ার যে ভিশন হাতে নিয়েছেন, তা কোনোভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সূত্র আরো জানায়, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা করোনাকালীন সংকটের মধ্যেও উৎপাদন চালু রাখতে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করছে। নতুন বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের নানা দরজায় দৌড়ঝাঁপ করেও ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকটে পড়তে হচ্ছে। শিল্প বিনিয়োগের জন্য জরুরি মেয়াদি ঋণ পাওয়া এখন সবার জন্য কঠিন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকই মেয়াদি ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৪টি। মেয়াদি ঋণের জন্য ওই ব্যাংকগুলোর ওপরই সব ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাকে ভরসা করতে হচ্ছে। আর মেয়াদি ঋণ ছাড়া কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর চাপ যেমন বেশি, তেমনি তাদের সক্ষমতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিপরীতে বেসরকারি খাতে ৬৩টি ব্যাংকের সবগুলোই সহজ ব্যাবসায়িক ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। তার মধ্যে আছে ক্ষুদ্রঋণ, এসএমই ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ, কনজ্যুমার ঋণ। তাছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের কার্ডভিত্তিক বাণিজ্যে মুনাফাও তুলছে। আর শিল্পঋণের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ওসব চলতি মূলধন দেশে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে তেমন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না। চলতি মূলধন দিয়ে সাধারণত কাঁচামাল, ইউটিলিটি, বেতন-ভাতা বা খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের কাজ চলে। এদিকে এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মাতলুব আহমাদ জানান, শিল্প বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ খুবই জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ছাড়া শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা কঠিন। ব্যবসা করাও কঠিন। এদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ভাব দেখলে মনে হয় স্বল্প সময়ে ব্যবসা করার জন্যই তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে চায় না। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য আলাদা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক করা প্রয়োজন। স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিয়ে কখনো দেশের বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। আর বর্তমান অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি শিল্প খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়া কোনোভাবেই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়। দেশে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে শিল্পায়ন করতে হবে। আর শিল্পায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ভূমিকা রাখা দরকার। তাহলেই কেবল দেশকে উন্নত দেশগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply