হাসান আলী ॥ দেশসেরা উর্বরা কৃষি জমি ও উদ্ধৃত্ত খাদ্য শস্য উৎপাদনের অঞ্চল ও নদী বহুল খ্যাত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা কুষ্টিয়া। জেলার মোট ১লক্ষ ৬২হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১লক্ষ ১৭হাজার হেক্টর কৃষি জমি হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে অতি উর্বরা তিন বা অধিক ফসলী কৃষি জমির পরিমান- মাত্র ৭৬ হাজার হেক্টর। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর এসব কৃষি জমিতে উৎপাদিত খাদ্য শস্য জেলার প্রায় ২২ লক্ষ মানুষের বার্ষিক খাদ্য চাহিদা পূরন করেও উদ্ধৃত্ত খাদ্য শস্য সরবরাহ করে দেশের অন্যান্য জেলায় খাদ্য চাহিদার যোগান দিচ্ছে। খাদ্য শস্য উৎপাদনে এমন গৌরবময় অর্জন থাকলেও জেলায় ক্রমবর্ধমান কৃষি জমি ধ্বংসের শংকার কথা জানাচ্ছেন তারা। একই ভাবে নদী-নালা, খালবিল, হাওর- বাওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধার অস্তিত্ব বিপন্নের মুখে জেলার জল সংকটসহ নানবিধ পরিবেশ বিপর্যয়ের ষৌলকলার পূর্নতা পেয়ে জেলাবাসীর স্বাভাবিক জীবনকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ফেলেছে যার নমুনা এবছরের শুষ্ক মৌসুমে জেলার অন্তত: ৮০% পানীয় জলের কলগুলি পানির স্তর সংকটে অকেজো হওয়ার মধ্যে দিয়ে দৃশ্যত: হয়েছে।
জেলার ইটভাটা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের কৃষি জমি আগ্রাসন, নদী-খাল ও প্রাকৃতিক জলাধার গুলি অবৈধ দখলবাজের খপ্পরে তিল তিল করে হারিয়ে যাওয়াকে আত্মঘাতি ঘটনা হিসেবে দেখছেন কৃষি বিভাগ। ইটভাটা মালিকরা এই কাজকে বে-আইনী স্বীকার করলেও কিছুই করার নেই; কারণ এসব যারা দেখবেন তাদের সবাইকে ম্যানেজ করেই এসব করছেন বলে দাবি তাদের। এসব অভিযোগ নাকচ করে সংশ্লিষ্টরা একে অন্যের উপর দায় দিচ্ছেন। তারা বলছেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হলো- নামকাওয়াস্তে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই একটি অভিযান পরিচালিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অবশেষে পাল্টা-পাল্টি এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমে বিধি লংঘনের সত্যতা পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন দুদক কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক হাফিজুল ইসলাম।
সর্বোচ্চ পরিমান কৃষিজমিতে ইট ভাটাসহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পূর্বে জেলা প্রশাসন থেকে নিয়ম মেনে লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক ছাড়পত্র নেয়ার কথা থাকলেও কোন ইটভাটা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিক তাদের স্থাপনার আইনগত শর্ত পালন করছেন না। কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলার বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে গড়ে উঠা তালিকাভুক্ত জেলা প্রশাসন কর্তৃক সনাক্তকৃত ১৫০টিসহ দুইশতাধিক ভাটা মালিক এবং অর্ধশত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের কেউই আইন মানছেন না। এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ৬টি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণ। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ভূমি জোনিং এ্যাক্ট-২০১০, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন-২০১৫, পরিবেশ সুরক্ষা আইন-১৯৯৫সহ ইটপ্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনে আইনগত নীতিমালা-২০১৩ সবই লংঘিত হয়েছে উপজেলার সকল ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে। একইভাবে অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও অভিন্ন চিত্র বিদ্যমান। সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষথেকে এবিষয়ে অভিযানে গিয়ে তাদের কাছে ইটভাটা ও শিল্প স্থাপনের লাইসেন্স বা ছাড়পত্র কিছুই পাওয়া যায়নি।
ইটভাটা মালিক সমিতির নেতৃবৃৃন্দ- বশির উদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মহিদুল, মনিরুল, খোকনসহ আরও একাধিক সদস্যের সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমরা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরেই নিয়মিত টাকা দিচ্ছি। যদি অবৈধ হই তাহলে আমাদের কাছ থেকে এসব টাকা কেন নেয়া হচ্ছে ? কেনইবা মাসে মাসে চাঁদে চাদে প্রশাসন অভিযানের নামে এসে জরিমানা আদায় ও ভাটা ভাংচুরসহ নানাভাবে আমাদের আর্থিক ক্ষতি সাধন করছেন ? আমরাও চাই এর একটা সঠিক সমাধান হোক। যেহেতু অধিকাংশ ভাটা মালিকই আইন-কানুন সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নয়। কোন্ জমিতে ভাটা করলে কৃষি ও পরিবেশ ধ্বংস হবে না সেটা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনই ঠিক করে দিন। টাকা যখন দিচ্ছি; তাহলে আমাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দাবিও করছি প্রশাসনের কাছে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার যুগিয়া গ্রামের কেএইচবি ভাটার পোড়ায় মিস্ত্রী রাজু মিয়া জানান, কাঠ পুড়িয়ে ইটের উৎপাদন ভালো হয়; কয়লা পোড়ালে মোট ইটের তিন ভাগের মধ্যে এক ভাগ ইট নষ্ট হয়ে যায়। সমানতালে পোড়ে না। সেকারনে কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতি ৫লক্ষ ইটের একটি ভাটায় প্রতিদিন প্রায় ৪শ মন বা ১৬ মে:টন কাঠ পোড়ানো হয়। এক রাউন্ড ইট পোড়াতে ২২/২৩ দিন সময় লাগে। বছরের ইট পোড়ানো মৌসুমে ৫ মাসে প্রতি ভাটায় কমপক্ষে ৫রাউন্ড করে ইট পোড়ানো হয়।
পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, ১৫২টিসহ প্রায় দুই শতাধিক ইটভাটা। এক মৌসুমে গড় ৫রাউন্ডে ১৩০দিন ধরে ইট পোড়ানো হয়। প্রতি ১টি ভাটায় ১দিনে ১৬মে:টন কাঠ পুড়লে এক মৌসুমে কাঠ পোড়াচ্ছেন ২০৮০ মে:টন। জেলার সবগুলি ইটভাটার হিসেব মতে, প্রায় ৩লক্ষ ১২হাজার মে:টন কাঠ পুড়ছে ভাটাগুলিতে। একইভাবে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ভু-উপরিভাগের প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস করে কার্যত: আমরা নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতি হয়ে উঠর্ছি যার ভয়াবহ পরিনামেই আজ আমরা সুস্থ্য জীবনকে বিষিয়ে তুলেছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর(খামার বাড়ি) কুষ্টিয়ার উপপরিচালক শ্যামল কুমার বিশ^াস বলেন, বাংলাদেশে কৃষি ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইটভাটা। গত এক দশকে জেলার অতি উর্বর তিন ফসলী ৭৫হাজার ৮শত ৮০হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক হেক্টর কৃষি জমিতে গড়ে উঠা ইটভাটাসহ অপরিকল্পিত শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংস করেছে কৃষিকে। সেই সাথে এর দুষণ ও বিরূপ প্রভাবে আক্রান্ত পরিবেশ চুতুর্দিকে আরও ৪গুন জমি ফসলহানির শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ জেলার মোট কৃষি জমির ৭% শতাংশের অধিক পরিমান বন্ধাত্বের শিকার হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত উপ-পরিচালক(শস্য) ড. হায়াৎ মাহমুদ বলেন, উদ্ধৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলার মধ্যে কুষ্টিয়া অন্যমত। নানাবিধ কারণে উদ্ধৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের এই ধারা ক্রমান্বয়ে শংকাগ্রস্ত হয়ে উঠছে কৃষি জমি ধ্বংসের ফলে। ক্রমবর্দ্ধমান গতিতে নানামুখি অকৃষিজ খাতে চলে যাচ্ছে ফসল আবাদি জমি।
অনুমোদন ছাড়াই ভাটা ও যত্রতত্র গড়ে উঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকরা সবাইকে ম্যানেজ করে, কৃষি জমিতে ইট ভাটা ও কলকারখানা স্থাপন নীতিমালা লংঘন করছে; দুদক সদর দপ্তরে প্রাপ্ত এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনকে সাথে নিয়ে পরিচালিত অভিযানে ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন বলে জানালেন দুদক কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক হাফিজুল ইসলাম।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বলেন, জেলায় মাত্র ২৬টি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া থাকলেও অন্যদের কোন ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। কিভাবে এসব ভাটা চলছে তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলতে পারবেন। একইভাবে অপরিকল্পিত ও যত্রতত্র কৃষি জমিতে শিল্পায়নেও ঘটছে নানামুখী পরিবেশ দুষণ। লোকবল সংকটে এই বিস্তৃত এলাকার সবগুলি দেখভালের আওতায় আনা সম্ভব হয়ে উঠেনা। তবে এসব অবৈধ ভাটা মালিকদের সাথে পরিবেশ অধিপ্তরের কারো সাথে কোন অনৈতিক সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তিনি।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, জেলায় ভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে ভাটা মালিকরা নীতিমালা লংঘন করে এসব করছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ ইচ্ছে করলেই জমির শ্রেনী পরিবর্তন করতে পারবেন না। কৃষি জমিকে অকৃষিজ দেখিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে এমন অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানালেন তিনি।
সম্প্রতি পরিদর্শন শেষে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিব কুষ্টিয়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শংকা জানিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন “কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভুগর্ভস্থ ও পানীয় জলের সংকট নিরসনে সারফেস ওয়াটার বা উপরিভাগের জলাধার সংরক্ষনের বিকল্প নেই। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারেজ স্থাপনের সকল সম্ভাব্যতা যাচায়ে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে কাজ করছেন। সম্ভাব্যতা যাচায় শেষে বিশেষজ্ঞের দেয়া প্রতিবেদন ও মডিউল অনুযায়ী পদ্মা-গঙ্গা ব্যারেজ স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হবে। এবিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন”।
চলতি শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি প্রবাহ নিম্নগামী হওয়ায় জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প হাউজ থেকে খালে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বোরো আবাদের ভরা সময়ে পানি সংকট এবং ভু-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয় জেলাজুড়ে। পানির এই সংকট নিরসনের স্থায়ী উদ্যোগের কথা এভাবেই বলছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার।
এসময় সচিব আরও বলেন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ড্রেজারে খনন বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে যে সব ভুমি পূনরুদ্ধার হচ্ছে সেখানে যাতে অবৈধচক্রের অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারেও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। অর্থাৎ গড়াই খনন প্রকল্প বাস্তয়নের মাধ্যমে নদীর আশপাশ এলাকায় সম্পন্ন হওয়া কোন উন্নয়ন যেন কেউ ভেস্তে দিতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে এখানে স্থায়ীভাবে দেখভালের জন্যই সাইট অফিস নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০জেলা ও বিশে^র গ্রেট ম্যানগ্রোভ সুন্দর বনাঞ্চলের লবনাক্ততার আগ্রাসন রুখতে এবং জীববৈচিত্র রক্ষা, জলপথ সচলকরণ, মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধিসহ কৃষি উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব সৃষ্টির লক্ষে দীর্ঘ ৩দশক ধরে বিভিন্ন সময়ের মেয়াদকালে চলছে গড়াই নদী খনন প্রকল্প। এখাতে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করেছে সরকার। কিন্তু এই প্রকল্পের ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় এর কার্যকারিতা নিয়ে। এই পরিস্থিতির উত্তোরণে গড়াই খনন প্রকল্প কঠোর নজরদারিসহ এই অঞ্চলের অস্তিত্ব সংকটে থাকা নদীগুলি উদ্ধার এবং পর্যাপ্ত বনায়নে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।