ঢাকা অফিস ॥ দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে পাশে থাকায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র-প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। মানুষের শক্তিতে তিনি সব সময় বিশ্বাস করেন। তাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বুধবার এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করা হয়। এরপর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের পেছনে কে বা কারা ছিল, তা বহুবার বলেছি।’ ব্যক্তিস্বার্থে বিশেষ এক ব্যক্তির উদ্যোগে ষড়যন্ত্র শুরু হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরে আরও কয়েকজন যুক্ত হয়েছে। দুর্নাম রটানো হয়, দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। ব্যাংকের একটি এমডি পদ একজনের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয় কী করে! ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের জন্য দেশের মানুষের কেউ ক্ষতি করতে পারে; এটা সত্যিই কল্পনার বাইরে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই ষড়যন্ত্রকারীরা ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরে একটি গ্র“প ছিল, যারা অন্যায্যভাবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য করার লক্ষ্যে পরোক্ষ চাপ দিতে থাকে। রাজি হইনি। এর পর থেকেই তারা পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে বাধা দিতে থাকে। দুদক তদন্ত করে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। পরে কানাডার আদালতেও প্রমাণিত হয়, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী জানান, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে জাপান সফরে পদ্মা ও রূপসা নদীর ওপর সেতুর প্রস্তাব দিলে জাপান রাজি হয়। ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর সমীক্ষার তথ্য আসে। ওই বছরের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। ব্যয় বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়। পরের বছর জানুয়ারিতে সংশোধিত ডিপিপি দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতুর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করার কারণে ব্যয় বাড়ে। এরপর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছে। যুক্ত করা হয় রেল সংযোগ। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয়। পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও গভীরতা বাড়ে। বাড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ব্যয়। ২০১৭ সাল থেকে সরকার জমি অধিগ্রহণে জমির দামের তিন গুণ অর্থ দেওয়া শুরু করে। ২০১৬ সালে সেতুর খরচ আবার বাড়ে। ওই সময় ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৯ টাকা কমে যায়। নদীশাসনে নতুন করে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার যুক্ত হয়। সব মিলে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ বেড়ে যায়। নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। সব মিলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। কেন ‘তাদের’ আত্মবিশ্বাসের এত অভাব: দুর্নীতির কথিত অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে দেশে যারা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, নাম ধরে ধরে তাদের বক্তব্যের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ করে বিজয়ী জাতির মনোবল কেন তাদের নেই, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে পারে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। যারা বাংলাদেশের নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না কেন এদের ভেতরে আত্মবিশ্বাসের অভাব? তারা ভুলে যান যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে। আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা যখন একটা কথা বলি, ভেবে চিন্তেই বলি। কারণ বিজয়ী জাতি হিসেবে সেই মানসিক শক্তি নিয়েই কথা বলি। “কিন্তু উনাদের ভেতর যেন একটা পরাজিত মনোভাব। মনে হয় যেন পাকিস্তানি আমলে এই প্রদেশে একটা যে পরাধীনতার গ্লানি, তারা সব সময় সেই আত্মগ্লানিতেই ভোগেন। এজন্য তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব।” শেখ হাসিনা বলেন, “কিন্তু আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি যেটা পারব, সেটাই বলব। যেটা বলব, ইনশাল্লাহ সেটা আমি করব। সেটা আমি করে দেখাতে পারি, সেটা আমরা করেছি। এজন্য দেশবাসীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।” বিশ্ব ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তি করলেও পরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে, যা নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েন চলে। কিন্তু সেই অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে পারেনি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় নির্মিত এ সেতুতে এখন যান চলাচাল শুরুর অপেক্ষায় পুরো দেশ। প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর কে কোন ভাষায় তার সমালোচনা করেছিলেন, তার বিস্তারিত তালিকা প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনে। প্রথমেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেত্রী বললেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না।’ পদ্মা সেতু হয়েছে।” তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৯৬ সালে যখন সরকারে ছিলাম, তিনি আমাদের অর্থ সচিব ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে বললেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তী ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোনো দাতা সংস্থা কোনো নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হবে, তারা দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে, তাহলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে।’’ শেখ হাসিনা বলেন, “আশা করি পদ্মা সেতুর কাজের মান নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। কাজেই, যে কথা তারা বলেছে, এ কথার কোন ভিত্তি নাই।” তিনি বলেন, “এখানে খালেদা জিয়া আরেকটা কথা বলেছিল, যেটা ছিল ১৭ অক্টোবর, ২০১১। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল। “খালেদা জিয়া নিজেই ভুলে গেছে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের টাকা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে আর সেই দুর্নীতির সাথে তিনি, তার পুত্ররাও জড়িত ছিলেন…এটা আমাদের কথা না, এটা আমেরিকার এফবিআই কিন্তু এই তথ্যটা বের করেছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের টাকা বন্ধ করে দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ওই দুর্নীতির কারণে।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বদিউল আলম মজুমদার (সুজন সম্পাদক) বলেছিলেন, দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে, এই ঘটনা তারই আরেকটি উদাহরণ।’ “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মামলা করেও কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে নাই। কিন্তু তারা দুর্নীতি দেখেছে।” শেখ হাসিনা বলেন, “ড. আহসান এইচ মনসুর, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেছেন…‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না।’ “আমরা কিন্তু শেষ করেছি, তাকেও দাওয়াত দিচ্ছি।” সরকারপ্রধান বলেন, “ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি। ‘বিকল্প উৎস হতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দৃষ্টি সরানোর উপায় বলে মনে হতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত সফলও হয়, তাতেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।’ “বর্তমানে বাংলাদেশের বা আওয়ামী লীগ সরকার আমি চালাচ্ছি। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে আছে কিনা আপনারাই বিচার করবেন, বাংলাদেশের জনগণ বিচার করবেন।” শেখ হাসিনা বলেন, “প্রয়াত বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার বলেছিলেন, ‘নিজস্ব অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নাই।’ “বিএনপি কী বলেছে ওটা আমি ধর্তব্যে নিই না।… ওটা বলে আর সময় নষ্ট করতে চাই না। তবে আমাদের অর্থনীতিবিদ বা বড় বড় জ্ঞানী, গুণীরা কি বলছেন, সেটাই আমি বলি।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ড. সালেহ উদ্দীন, প্রাক্তন গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শেষ করতে পারবে না।’ “আমি চাই তাকেও দাওয়াত দিতে। এটা যে শেষ হয়েছে তিনি যেন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে একটু যান। আমি দাওয়াত দিচ্ছি। সবাইকে দাওয়াত দেব। যারা যারা এই কথা বলেছেন, সবাইকে দাওয়াত দেব বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, “আইনজীবী শাহদীন মালিক। উনি সব সময়ই স্বাধীন। সব সময় স্বাধীনই থাকেন এবং স্বাধীন মালিক তিনি। শাহদীন মালিক স্বাধীন কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু দেশী অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়।’ “সম্ভব হয়েছে। তাকে দাওয়াত দিচ্ছি। তিনি যেন পদ্মা সেতুতে আসেন।” সরকার প্রধান বলেন, “ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা জোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না।’ “আমাদের রিজার্ভ কিন্তু এখনো ৪২ বিলিয়ন। আর বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়েনি। সাথে অন্য প্রকল্পগুলো কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি।” শেখ হাসিনা বলেন, “প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।’ “সব কাজগুলো কিন্তু চলছে। কোনটা কিন্তু থেমে যায়নি।” ‘কিন্তু তারা সাহস দেখিয়েছেন’ : সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ও দেশের সবচেয়ে বড় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেও নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেল আজকে জামিলুর রেজা সাহেব নেই, আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই, যখন বিশ্ব ব্যাংক থেকে এই রকম… মহারথীরা সরে গেল কিন্তু তারা কিন্তু সরে যাননি। তারা কিন্তু সাহস দেখিয়েছেন এবং তারা এই উপদেষ্টা প্যানেল, তারা কিন্তু কাজ করেছেন এবং তারা যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন, হয়তো আমরা এটা করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। তারা কিন্তু পিছু হটেননি।” যারা ওই সময়ে সাহস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সিদ্ধান্তের পাশে ছিলেন, তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমি অত্যন্ত খুশী হতাম, যদি আজকে জামিলুর রেজা সাহেব বেঁচে থাকতেন, এই সেতুটা দেখে যেতে পারতেন।” পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারীদের ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী: পদ্মা সেতুর যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘তাদের বিরোধিতার কারণে আমরা যে আত্মমর্যাদাশীল, আমরা যে পারিÑ সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি। এতেই আমরা খুশি। এর বেশি নয়।’ পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক বা বিরোধিতাকারীরা দুঃখ প্রকাশ করেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কথা হলো, নিজের ভাড় ভালো না, গোয়ালার ঘির দোষ দিয়ে লাভ কী? বিশ্বব্যাংককে আমি কী দোষ দেবো। তারা বন্ধ করলো কাদের প্ররোচনায়। সেটা তো আমাদের দেশেরই কিছু মানুষের প্ররোচনায় তারা বন্ধ করেছিল। এটাই তো বাস্তবতা। আর যারা বিভিন্ন কথা বলেছেন, তাদের কিছু কথা আমি উঠালাম। কথা আরও আছে। সেখানে আমার তো কিছু বলার দরকার নেই। এটা তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে, যদি তাদের অনুশোচনা থাকে। আর না থাকলে আমার কিছু বলার নেই। আমার কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বরং আমি ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এ জন্যই যে, এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলেই আমরা সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পেরেছি। আজকে বাংলাদেশের সম্মানটি ফিরে এসেছে। আমাদের দেশের বিষয়ে সবার একটা পারসেপশন ছিল, একটা মানসিকতা ছিল যে, আমরা অন্যের অর্থায়ন ছাড়া কিছুই করতে পারবো না। এই যে পরনির্ভরশীলতা, পরমুখাপেক্ষিতা আমাদের মাঝে ছিল। দৈন্যতা ছিল। বিশ্বব্যাংক যখন টাকাটা তুলে নিয়ে গেলো অন্তত আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। সেই অচলায়তন ভেঙে আমরা যে আত্মমর্যাদাশীল, আমরা যে পারিÑ সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি।’ পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করলেও বাংলাদেশের নামে বরাদ্দকৃত টাকা তারা ফেরত নিতে পারেনি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক কোনও অনুদান দেয় না। আমরা লোন নেই। যে টাকাটা বাংলাদেশের নামে স্যাংশন হবে, সেটা নষ্ট করার কোনও রাইট তাদের নেই। পদ্মা সেতু থেকে টাকা তারা বন্ধ করছে, কিন্তু ওই টাকা আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এই টাকা আমরা অন্যান্য প্রজেক্টে ব্যবহার করতে পেরেছি।’ বিশ্বব্যাংক কোনও একটি দেশের একটি প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিলে দেশটি চাইলে অন্য প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারে এমনটি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কিন্তু করা যায়। তা কিন্তু অনেকে জানেন না। জানিনা কেন জানেন না। আমাদের যারা অর্থনীতিবিদ, যারা কাজ করে, তারা কেন মাথায় রাখেন না। এরা (বিশ্বব্যাংক) দাতা নয়। আমরা তাদের থেকে ভিক্ষা নেই না। ব্যাংকের একটি অংশীদার হিসেবে আমরা লোন নেই এবং সুদসহ সেই লোন পরিশোধ করি। কাজেই আমার নামে, বাংলাদেশের নামে যে টাকা হবে, সেই টাকা তাকে (বিশ্বব্যাংক) দিতে হবে। সে বাধ্য। জ্ঞানীগুণীরা বলেন, টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। কীসের জন্য? আমরা তো লোন নিচ্ছি। যে লোন বাংলাদেশের নামে স্যাংশন হবে সেই লোন কোনও না কোনোভাবে তাকে দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ওই দাতা কথাটি বন্ধ করে দিলাম। আমি বলেছি, কীসের দাতা। এরা তো উন্নয়ন সহযোগী।’ গণমাধ্যমেরও এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত উল্লেখ করে সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু কারও থেকে ভিক্ষা নেই না। আমরা ঋণ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধও করি। এটুকু ঠিক, সুবিধাটা স্বল্প সুদ। আমাদের কেউ করুনা করে না। আমরা কারও করুনা ভিক্ষা নিইনি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একসময় আমরা কনসোর্টিয়ামের মিটিংয়ে প্যারিসে যেতাম। আমি বললাম, প্রত্যেক দিন আমরা যাবো কেন? ওরা এসে এখানে টাকা দিয়ে যাবে। আমি শুরু করলাম। আমরা ঢাকায় মিটিং করেছি। এই টেকনিক্যাল জিনিসগুলো জানা দরকার। আমাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’ ‘ব্যাংকের এমডি কীভাবে ফাউন্ডেশনে বিপুল অনুদান দিলো’ : একটি ব্যাংকের এমডি হয়ে একটি ফাউন্ডেশনে কীভাবে এত ডলার অনুদান দিল সেই প্রশ্ন তুলে গণমাধ্যমকে তা তদন্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে যদি কোনও তথ্য লাগে তিনি তার জোগান দেবেন বলেও জানান। তিনি নিজে এটা করতে গেলে ‘প্রতিহিংসা’র প্রশ্ন আসতে পারে বলেও মন্তব্য করেন। ‘পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে অভিযুক্ত’ ড. মুহম্মদ ইউনূসের ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে দেওয়া অনুদান প্রসঙ্গে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থ বরাদ্দ বন্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সেই বিষয়ে তদন্ত করা হবে কিনা সাংবাদিক রাশেদ চৌধুরীর এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ৫৪টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। কার এত আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে, একজন এমডি একটি ফাউন্ডেশনে এত ডলার দিল অনুদান হিসাবে, অথবা এত ডলার খরচ করলো কীভাবেÑ সেটা আপনারা তদন্ত করলে ভালো হয় না? আমি করতে গেলে বলবেন, প্রতিহিংসার জন্য এটা করছি। তাই আপনারা সাংবাদিকরা করলে সেটা আরও ভালো হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও তথ্য আছে। কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, কোন চেকে কত টাকা সরালো, সেইসব তথ্যও আছে। বের করেন না। সব আমরা বলবো কেন? আপনারা একটু খুঁজে বের করেন। তারপরে যদি কিছু লাগে জোগান দিবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ট্রাস্টের টাকা বেসরকারি ব্যাংকে কীভাবে যায়? এক চেকে ছয় কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায় নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে…। আমরাও তো ট্রাস্ট চালাই, তার চেয়ারপারসন হবার পরেও আমার ব্যক্তিগতভাবে টাকা তোলার কোন রাইট নেই। আমার কাছে এই তথ্যও আছে ট্রাস্ট থেকে ব্যক্তিগত চেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে, তারপর সেই টাকা উধাও। গেলো কই? বেশিদিনের কথা না, ২০২০ সালের কথা। তার হিসাব নম্বর সবই আছে। বলতে চাই না। আপনারা বের করেন। তিনি বলেন, এত স্বনামধন্য বিখ্যাত ব্যক্তি, আমি কিছু বললে… আমরাতো লেখাপড়া জানি না, কিছুই জানি না। আমাদেরতো বলা শোভা পায় না। এত জ্ঞানীতো না। সাধারণ মানুষ। একেবারে নিরেট বাঙালি মেয়ে। তাও আবার বাংলায় পড়েছি। ‘বন্যা সামলানোর প্রস্তুতি আছে’ বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে, সে কথা তুলে ধরে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, “বন্যা শুরু হয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যার ঝুঁকিটা আমাদের থাকে, পানিটা নেমে আসবে দক্ষিণ অঞ্চলে। সেজন্য আগাম প্রস্তুতি আমাদের আছে।” সিলেট অঞ্চলে এবারের ভয়াবহ বন্যার কথা তুলে ধরে সেখানে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম,পানি যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে,প্রয়োজনে রাস্তা যেন কেটে দেয়। “এটাও আমাদের একটা শিক্ষা, কোন জায়গা থেকে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে, কারণ আমাদের এখানে তো বন্যা আসবেই।সেটা চিহ্নিত করে রাখতে বলেছি, সেখানে ব্রিজ কালভার্ট এমনভাবে করে দেব, যাতে পানি জমা থাকতে না পারে।”
ওই অঞ্চলে আরও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র করার পাশাপাশি বন্যার কথা মাথায় রেখে অবকাঠামো করার কথাও সরকারপ্রধান বলেন। তিনি বলেন, “অনেক দিন এরকম বন্যা হয়নি, আবার বন্যা আসলো। সেইভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।” বন্যার পর কৃষক যেন কৃষিকাজ করতে পারে, সেজন্য বীজ, সারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা কষ্ট করে যারা বন্যার মধ্যে কাজ করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সিলেট অঞ্চলে এবারের বন্যাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এবার সবথেকে ভয়াবহ বন্যা আমরা পেয়েছি, কিন্তু এটা আমাদের মোকাবেলা করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এটা তো আর মানুষ ঠেকাতে পারে না। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মানুষের ক্ষতিটা যাতে না হয় সেটা আমাদের দেখা দরকার।” বন্যা মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সরকারপ্রধান বলেন, “সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছ্।ে এটাই সব থেকে বড় কথা। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন এবং সব জায়গায় তারা কাজ করছেন। “যারা আমাদের…বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে পুলিশ কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরা ও অন্যান্য কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভিজে, পানির মধ্যে পায়ে হেঁটে হেঁটে মানুষকে উদ্ধার করা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কাজ করে যাচ্ছেন।” “কাজেই আমি এটা বলব, প্রত্যেকের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে; কাজেই যেখানেই বন্যা হবে আমরা সেভাবেই সেটা মোকাবেলা করব,” বলেন তিনি। দুর্যোগ প্রশমনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ও ত্রাণতৎপরতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১শে জুন ২০২২ পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর যেই কার্যক্রম, সেখানে সেনাবাহিনীর ১৭ ও ১৯ পদাতিক ডিভিশন তারা উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেছে। “প্রায় ১১ হাজার ৩৮০ জন এবং ২৩ হাজার ৪৪৬ পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ৩১৪ পরিবারকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। “নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা ও ডুবুরি মিলে ১০৬ জন, তারা সেখানে প্রায় ২০০ পরিবার উদ্ধার করেছে এবং ৮০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছে এবং ৩০ পরিবারকে চিকিৎসা দিয়েছে।” তিনি বলেন, “বিজিবি কর্মকর্তা ও সৈনিক মিলে প্রায় ১ হাজার ৬২০ জন, তারা ১ হাজার ২৫০ পরিবার উদ্ধার করেছে; ৪ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে এবং পাঁচশ পরিবারকে চিকিৎসা দিয়েছে। “কোষ্টগার্ডের ৮০ জন একশ পরিবারকে উদ্ধার করেছে, ৬০০ পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী দিয়েছে, ৩০টি পরিবারকে উন্নত চিকিৎসা দিয়েছে।” বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চলে ১ হাজার ২৮৫টা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “৩০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে। গতকাল (মঙ্গলবার ) পর্যন্ত বন্যা কবলিত ১১টি জেলায় ৯০০ মেট্রিক টন চাল এবং ৩ কোটি ৩৫ লাখ নগদ টাকা ও ৫৫ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে শুকনা খাবার যেমন দেওয়া হয়েছে, অনেক জায়গায় খাবার রান্না করেও বিতরণ করা হচ্ছে।” বন্যা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে যে তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো কাজে লেগেছে মন্তব্য করে সাংবাদিকদের ধন্যবাদও জানান তিনি।
Leave a Reply