কৃষি প্রতিবেদক ॥ স্বল্প খরচ আর কম সময়ে সরিষা চাষ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষা চাষ। প্রচলিত দেশি সরিষার চেয়ে বারি-১৪ ও বারি-১৫ ফলন বেশি হওয়ায় চাষিরা আগ্রহী হচ্ছেন। অনেকেই আমন ধান সংগ্রহের পর জমি পতিত ফেলে না রেখে সরিষা চাষ করছেন। এরপর আবার বোরো ধান রোপণ করছেন কৃষকরা। তাতে করে একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন হচ্ছে। সরিষা বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্য তেল ফসল। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে এর চাষাবাদ করা হয় এবং প্রায় আড়াই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০ শতাংশ আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। সরিষার তেলে উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এছাড়া ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের একটি আদর্শ অনুপাত (২:৫:১) থাকায় এটি স্বাস্থ্যের জন্য অতি উপকারী। এছাড়া সরিষার তেল হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও ঝাঁজের কারণে রসনাবিলাসের পাশাপাশি ভোজ্যতেলের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করছে সরিষা। সরিষার তেলবীজে জাতভেদে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ তেল থাকে। এ উৎপাদন দেশের মোট চাহিদার মাত্র ১৫-২০ শতাংশ পূরণ করছে। ভোজ্যতেল আমদানিতে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। সরিষা জাতগুলো আবাদের মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের সংকট অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশে বর্তমানে তেলের চাহিদা প্রায় ৬ দশমিক ২৮ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১ দশমিক ৮৫ লাখ টন। ঘাটতি রয়েছে ৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। তেলের এ বিশাল ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে বিনা সরিষা-৪। দেশের ৫৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে বিনা উদ্ভাবিত এ সরিষা চাষ করে প্রায় ৬ লাখ টন তেল উৎপাদন সম্ভব। এতে করে আর বিদেশ থেকে তেল আমদানি করতে হবে না। সরকারেরও বছরে সাশ্রয় হবে আড়াই হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমান বাণিজ্যিক কৃষিতে শস্যবিন্যাসে ফসলসহ এমন চাষাবাদ পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে, যাতে ফসল চাষে লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি আসে। খুবই কম খরচে সরিষা আবাদ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। সরিষা আবাদে একর প্রতি রাসায়নিক সার প্রয়োগ, প্রয়োজনে একটি সেচ দেওয়া এবং পাতা ও ফলের অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ ও জাবপোকা দমনে বালাইনাশক প্রয়োগ এবং সরিষা সংগ্রহ ও মাড়াই বাবদ আনুমানিক ১৩ হতে ১৪ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। একর প্রতি গড়ে ১২ মণ সরিষার ফলন প্রাপ্তিতে আয় হতে পারে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনাচাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদ করে উৎপাদন খরচ বাদে একর প্রতি প্রায় ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। সরিষা চাষে প্রচুর রোদ, কম তাপমাত্রা ও জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ও মাটিতে রসের অভাব হলে বীজের আকার ছোট হয় ও বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। এজন্য বাংলাদেশে রবি মৌসুমেই সরিষার চাষ করা হয়ে থাকে। সরিষা চাষ দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যে দেখা যায় গত বছর দেশে ৪৬.২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে ২৭.৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যদিও আমদানিকৃত তেলের বড় একটি অংশ শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত কয়েক বছরে এই আমদানি হার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম-বেশি হয়। তাই সাধারণভাবে একর প্রতি ইউরিয়া ৮০-৯০ কেজি, টিএসপি ৭০-৮০ কেজি, এমওপি ৪৫-৫৫ কেজি, জিপসাম ৫০-৬০ কেজি, জিংক সালফেট ৪ কেজি এবং বরিক এসিড ৩ কেজি বা বোরাক্স সার ৫ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া এবং অন্যান্য সারের সবটুকু জমি তৈরির শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ফুল আসার আগে অর্থাৎ বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের অভাব হলে চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর প্রথম সেচ এবং প্রয়োজনে ফুল ফোটা শেষ হলে দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। তবে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের নিচু জমিতে আমন ধান দেরিতে রোপণজনিত কারণে দেরিতে সংগ্রহ হয় বিধায় দুইটি অঞ্চলে জানুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত নাবিতে বপনযোগ্য বিনা সরিষা-৪ ও বিনা সরিষা-৯ এর বীজ বপন করা যাবে। আরও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেসব এলাকায় আমন ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ জমিতে হাঁটলে মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে এমন জমিতে সরিষা আবাদ করতে হবে। তাছাড়া আমন ধান সংগ্রহের পর জমিতে আগাছার উপদ্রব হয় না বা তুলনামূলকভাবে কম হয় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
লেখক ঃ ইমরান সিদ্দিকী