ঢাকা অফিস ॥ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘লজ্জা-শরম’ বলতে কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত শনিবার জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে গতকাল রোববার দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এমন মন্তব্য করেন। গত শনিবার দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের বিষয়াদি তুলে ধরতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্লজ্জ! সংসদে তার বিরুদ্ধে তার দলের লোকেরা কথা বলছেন, বিরোধী দলের কয়েকজন কথা বলেছেন, সারা দেশের মানুষ কথা বলছেন। তাদের মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি যখন প্রমাণিত হয়েছে, দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে যখন তিনি চিত্রিত হয়েছেন, ছবি তোলা হয়েছে এগ্রিমেন্ট সই করার সময়ে। তারপরেও তিনি পদত্যাগ করছেন না এবং লজ্জা-শরম কোনো জিনিস আছে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্য আমাদের যে এ রকম একটা ভয়ংকর গণবিরোধী সরকার যারা আমাদের সমস্ত অর্জনগুলোকে ধবংস করে দিচ্ছে। তারা এখনো সরকারে আছেন বহাল তবিয়তে। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার চরম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এই করোনাভাইরাসে যখন মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে, আপনি দেখুন তখন স্বাস্থ্যখাতে কীভাবে দুর্নীতি চলছে। আমরা প্রথম থেকে বলছিলাম জেলার হাসপাতালগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করা হোক, অক্সিজেন সরবারহের ব্যবস্থা করা হোক, ওষুধের ব্যবস্থা করা হোক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শতকরা ৫২টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড নেই। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে, একটা জেলা হাসপাতালে পর্যন্ত কোনো অক্সিজেন সরবারহের ব্যবস্থা নেই। গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে এতটুকু সরকারের সমালোচনা করলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে চরম নির্যাতন করা হচ্ছে। আমি দেখলাম, গত ৬ মাসে ১৫০ জনের মতো সাংবাদিককে তাদের শুধুমাত্র সত্য কথা লেখার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে। আজকে এই জাতিকে বাঁচানোর জন্য, তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কখনোই কোনো আন্দোলন সফল হয় না যদি আমরা ত্যাগ স্বীকার না করতে পারি। আমি অনুরোধ জানাবো, তরুণদের এখনই জেগে উঠতে হবে, এই ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে উঠে দাঁড়াতে হবে। এক সময়ের নাম করা সাংবাদিকরা যারা এখন ‘‘উচ্ছিষ্টভোগী’’ হয়েছেন তারা জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে নানারকম অপপ্রচার করে কলাম লিখছেন যা সত্য নয় উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সেই লেখাগুলোর বিরুদ্ধে আপনাদের জবাব দিতে হবে, সেগুলোর বিরুদ্ধে পত্রিকায় আপনাদের লেখা দিতে হবে। কিছুদিন আগে আবদুল গাফফার চৌধুরী যে সমস্ত লেখা লিখছেন আপনারা আমাদের মতাদর্শের যারা একজনও কিন্তু প্রতিবাদ করে কলাম লিখছেন না। অন্তত যে কথাগুলো তার সত্য নয়, সেগুলো তো আপনাদের বলতে হবে, লিখতে হবে, জনগণকে জানাতে হবে সত্যটা। জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে ‘মহান স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী: গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হয়। ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়াকে নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও শালীনতা বিবর্জিত। তিনি বলেন, বৈঠকে জাতীয় সংসদে দেশনেত্রীর বিদেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও শালীনতা বিবর্জিত বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানানো হয়। সভা মনে করে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়াকে সাজানো মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে সাংবিধানিক এবং প্রচলিত আইনের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তার প্রাপ্য জামিন পর্যন্ত তাকে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, অথচ একই ধরনের মামলায় অন্যান্য প্রায় সকল অভিযুক্তদের জামিন দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার বাসভবনে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা প্রশাসনিক নির্দেশ। আইনের কোথাও এ কথা বলা নেই যে, সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দিতে পারবে না। যেখানে খুনের মামলায়, ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুক্তি নিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারে, সেখানে খালেদা জিয়াকে মানবিক কারণে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়া যাবে না, এটা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, গতকাল (গত শনিবার) সংসদে সংসদ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার বক্তব্য অনভিপ্রেত এবং রাজনৈতিক শালীনতা বিবর্জিত। সংসদ নেতা তার মনগড়া কাহিনীর মধ্য দিয়ে একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্রের আপোষহীন নেত্রী এবং জনগণের আস্থাভাজন প্রিয় নেতাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। সভা এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। তিনি বলেন, সভা মনে করে এই নেতিবাচক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও আজীবন সংগ্রামী বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করবে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় জরুরি ত্রাণ বিতরণের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বৈঠকে ক্রমাগত বর্ষণের ফলে এবং ভারতের উজানে সকল বাঁধগুলোর গেট খুলে দেয়ার কারণে প্রায় ১০টি জেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অপরিকল্পিত এবং দুর্বল নির্মাণ কাজের কারণে সড়ক ও বাঁধগুলো ভেঙে যাওয়ায় দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হওয়ায় কৃষকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সভায় এইসব বন্যাদুর্গত অঞ্চলে অবিলম্বে সরকারি ত্রাণ বিতরণ এবং বীজতলা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় নতুন বীজ সরবরাহের দাবি জানানো হয়। উপদ্রুত এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের যথাসম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ওই সভায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিএনপি বারবার সতর্ক করবার পরও সরকার সংক্রমণ প্রতিরোধের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারার জন্য সরকারের উদাসীনতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। জেলা সদরে অক্সিজেনের অভাব, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার তীব্র সংকট, শতকরা ৫২ ভাগ জেলা হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড না থাকা, ওষুধের অপ্রতুল ঢাকার বাইরের জনগণের জীবন মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, একদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য ও দুর্নীতি, অন্যদিকে করোনা টিকার দুষ্প্রাপ্যতা কোটি কোটি মানুষের জীবন অনিশ্চিত করেছে। সভা মনে করে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য সরকারের উদাসীনতা দায়ী। প্রায় ১৫ মাস সময় নিয়েও সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রায় দুই কোটির ওপর মানুষ দরিদ্র হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের অপরিকল্পিত লকডাউন, সাধারণ ছুটি, সীমিত লকডাউন, কঠোর লকডাউনের ফলে মানুষ দরিদ্র হয়েছে। কর্মচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক ৮৫ শতাংশ, সংখ্যায় ৫ কোটিরও বেশি প্রকৃত অর্থে কর্মহীন। দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের জন্য সরকার কোনো পরিকল্পিত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, দিন আনে দিন খায় মানুষ, পরিবহন শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার এরা সবাই কর্মহীন হয়ে পরিবার নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। অথচ সরকার প্রণোদনা বাজেট বরাদ্দেও তাদের জন্য কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অবিলম্বে এসব মানুষের জন্য এককালীন ১৫ হাজার টাকা প্রদানের দাবি জানায় বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা। মির্জা ফখরুল বলেন, এ সভা মনে করে, সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে গত জানুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বিবরণ বেরিয়ে এসেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ধর্ষণ, হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, সাংবাদিক নির্যাতন এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহারে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। সভা এ বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, বর্তমান সভাপতি এম আবদুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আবদুল হাই শিকদার, বাকের হোসাইন, বাসির জামাল, রাশেদুল হক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মোরসালিন নোমানী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply