ঝিনাইদহ প্রতিনিধি ॥ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলা যোগীপাড়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান মিঠুকে ডেকে নিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শৈলকুপা থানা পুলিশ স্থানীয় ইউনুস কবিরাজ নামক এক ব্যক্তিকে আটক করেছে। ঘটনা সুত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নিখোঁজের ৯ দিনপর মিজানুর রহমান মিঠু (৫০) নামে একজনের অর্ধগলিত বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে থানা পুলিশ। বুধবার (১১ নভেম্বর) সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের যোগীপাড়া ধানক্ষেত থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত কৃষক ওই গ্রামের আজব আলী বিশ্বাসের ছেলে। পেশায় তিনি একজন কৃষক ছিলেন। এদিকে ইউনুসকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যাকান্ড পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নিহতের স্ত্রী বিউটি খাতুনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবারের অভিযোগ, মূল ঘটনার সাথে জড়িতদের আড়াল করতে পুলিশ ও মূল আসামী ইউনুস নিহতের স্ত্রী বিউটি খাতুনকে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলাকে অন্যদিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। বিষয়টি নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শৈলকূপা থানার মহাসিন জানান, ইউনূস ও নিহতের স্ত্রী একসাথে নিহত মিঠুকে খুন করে। আটককৃত ইউনূসের স্বীকারোক্তি মোতাবেক লাশ উত্তোলন ও গোলোপনগরের একটি কবরস্থান থেকে নিহতের মোবাইল ফোনসহ পোশাক উদ্ধার করা হয়েছে এবং ইউনুস আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
নিহত মিজানুর রহমান মিঠুর নিকটাত্মীয় জাহাঙ্গীর জানান, কৃষি কাজের পাশাপাশি মিঠু ঘটকালি পেশায় যুক্ত ছিলেন। যোগীপাড়ায় মিঠুর এক চাচাতো ভাই আইয়ানের মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে রতিডাঙ্গার তালুকদার ঘটকের সাথে তার ৫ হাজার টাকা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। মিঠুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ যে ইউনুস আলীকে গ্রেপ্তার করেছেন তিনিও কবিরাজির পাশাপাশি ঘটকালি পেশায় যুক্ত ছিলেন। এ হত্যাকান্ড তার একার পক্ষে ঘটানো সম্ভব হয়নি তার সাথে আরও ৪/৫ টন অবশ্যই জড়িত আছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আমার বোনকে ফাঁসানোর জন্য জড়ানো হয়েছে। আমার বোন কোন অন্যায়কারী না।
নিহতের প্রতিবেশী শাহাবুদ্দিন বলেন, পুলিশ যে বলছে নিহতের হত্যাকারী ইউনুস ও নিহতের স্ত্রী বিউটির সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেউ যদি এক থেকে দেড় বছর ধরে পরকীয়া করে থাকে তাহলে একটা লোক হলেও সেটি দেখতো বা জানতো। নিহতের বাড়ি জনবহুল এলাকার মাঝামাঝি স্থানে। এই এলাকায় সচরাচর মানুষের চলাচল দেখা যায়। কারোর বাড়ির কারো যাতায়াত থাকলে সেটা চোখে বাঁধবেই। এলাকার মহিলা-পুরুষ কেউই নিহতের স্ত্রী বিউটিকে খারাপ বলতে পারবে না। তার স্ত্রীর সব সময়ই গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকতো। তাছাড়া তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে ও ১৪ বছরের একটি ছেলে আছে। তার পক্ষে এসব কাজ করা কোনভাবেই সম্ভব না। সুপরিকল্পিতভাবে তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
আরেক প্রতিবেশী আমিরুল ইসলাম বলেন, নিহতের স্ত্রীর উপর যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে সেটা মিথ্যা, আদৌও মিথ্যা। গ্রামে হাজার হাজার লোক থাকলে হাজার হাজার লোক বলবে নিহতের স্ত্রী বিউটি খুবই ভালো মানুষ। প্রতিবেশী ফিরোজ বলেন, এ মহিলা যদি খারাপ হতো তবে আমরা অবশ্যই বুঝতাম। বিউটি এই গ্রামে ৩০ বছর বিয়ে হয়ে এসেছে। তাছাড়া তার বয়স আনুমানিক ৪৫ হবে। কখনো দেখিনি তার আচরণ বা চরিত্র কোন কিছুই খারাপ। মূলহোতা ইউনুস মহিলাটিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাসাচ্ছে। ইউনুস কবিরাজ ভালো মানুষ না।
প্রতিবেশী মন্টু বলেন, ঐ মহিলাটিকে জোর করে ফাঁসানো হচ্ছে। ইউনুস এর আগেও আরো দুইটি মার্ডার করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং ইউনুসের ফাঁসি চাই। ইউনুসের মূল বাড়ি হরিণাকুন্ডু উপজেলায়। ঐ এলাকায় মাডার সহ নানান অপকর্মে জড়িত থাকার কারণে সে নিজ এলাকায় যাইতে পারে না। এই এলাকায় তাঁর বাড়িতে মাঝে মাঝে তার নিজ এলাকার শক্ররা এসে হামলাও করে।
হত্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত ইউনুস আলীর স্ত্রী শাহনাজ বলেন, এ গ্রাম আমার বাপের গ্রাম। এ গ্রামে ইউনুস তেমন কারোর সাথে বেড়ায় না। যোগীপাড়ার লোকদের সাথে বেড়ায়। একজন নিরাপরাধ মানুষকে সে হত্যা করেছে, আমিও তার শাস্তি চাই। সে যদি একা করে তবে সে একা সাজা পাবে আর যদি কাউকে সাথে নিয়ে করে তারা সবাই সাজা পাবে। তবে নিহতের স্ত্রীর সাথে তার খারাপ সম্পর্ক ছিল কিনা সে জানেনা। তিনি আরো বলেন, আমার স্বামী আমার সাথে কখনো কোন খারাপ আচরণও করেনি। আমার মনে হয়না আমার স্বামীর সাথে কারো খারাপ সম্পর্ক আছে।
এদিকে “খুনি ইউনুস এর ফাঁসি চাই” “হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই” “নিরাপরাধী বিউটি আপার মুক্তি চাই” স্লোগানে নিহতের বাড়ির সামনে এলাকার সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের অংশগ্রহণে এক বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে এলাকার মহিলারা বলেন, আমাদের ঘরের সাথে বিউটির ঘর। আমরা বিস্তারিত সব জানি। মহিলাটি খুব ভালো মানুষ। আমাদের সাথে একসাথে থাকতো। এত ভাল মানুষ যে তার জন্য আমরা জান দিতে পারি। আমরা এই খুনের পিবিআই তদন্ত চাই।
নিহতের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে নাজনীন বলেন, আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার মাকে ইচ্ছা করে ফাঁসানো হয়েছে। আমি গত দেড় বছর যাবত করোনার কারণে সব সময় বাড়িতে আছি। আমরা দুই ভাইবোন ভালোমতোই সব বুঝি। এরকম কোন কিছুই কখনোই আমাদের চোখে পড়েনি। খুনি ইউনুস বলেছেন, তিনি নাকি প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু আমরা কখনই তাকে আমাদের বাড়ি আসতে দেখিনি। তিনি আরো বলেছেন, আমার মা এই হত্যাকান্ড পরিকল্পনার সাথে জড়িত। এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইউনূস বলেছেন, আমার বাবাকে তিনি একাই হত্যা করে একাই মাটিতে পুঁতে রেখেছে, আবার একাই নাকি লাশ তুলে নিয়ে ঘাড়ে করে অন্য জায়গায় নিয়ে ফেলে রেখে এসেছেন। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? কি করে একটা অর্ধগলিত লাশকে একা এক জায়গা থেকে তুলে অন্য জায়গায় কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারে? এগুলো আসলে অসম্ভব ব্যাপার। এই হত্যার সাথে যারা যারা জড়িত আছে তাদেরকে লুকানোর জন্য এ ধরনের শেখানো কথাগুলো বারবার বলে যাচ্ছে। আমার মায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পুলিশের কাছে নেই। আমরা এই খুনের তদন্তের ভার পিবিআই’র উপর ন্যস্ত করার জন্য অনুরোধ করছি।
নিহতের ছোট ভাই বলেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের আড়াল করতে পুলিশ ও মূল আসামি ইউনুস বিভিন্ন ধরনের তোতাপাখির মতো শেখানো কথা বলে যাচ্ছে। একটা বিয়েকে কেন্দ্র করে রতি ডাঙ্গার তালুকদার ঘটকের সাথে আমার ভাইয়ের গ্যাঞ্জাম হয়। তালুকদার আমার ভাইয়ের সাথে একসাথে একটি বিয়ের ঘটকালি করে ছেলে পক্ষের টাকা আমার ভাইকে মোটেও না দিয়ে উল্টো মেয়েপক্ষের টাকার অর্ধেক ভাগ চেয়েছিল। নিহতের বাল্যবন্ধু রবিউল ইসলাম জানান, মিঠু নিখোঁজ হবার পর তার স্ত্রী আমাদেরকে জানালে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে আটদশ দিন পর আমরা তার লাশ পাই। পরবর্তীতে এ ঘটনায় ইউনুস কবিরাজকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর আসামি মিথ্যা কথা অনুযায়ী আমার বন্ধুর স্ত্রীকে আটক করে চালান দিয়েছে পুলিশ। আমরা এটা মানতে পারিনা। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত করে বিচার চাই।
Leave a Reply