কুমারখালী প্রতিনিধি ॥ গত অর্থবছরের শেষ সময়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। সেজন্য চলতি অর্থবছরে পেঁয়াজ চাষে ব্যাপক আগ্রহ বাড়িয়েছে চাষিরা। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩৯০ হেক্টর বেশি জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাষিরা। তবে বেশি দামের আশায় অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন তাঁরা। ফলে প্রতি বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৫ মণ কম উৎপাদন হচ্ছে পেঁয়াজ। এতে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে কৃষি বিভাগ। উৎপাদন কম হওয়ায় চলতি অর্থবছরেরও পেঁয়াজ সংকট এবং চড়া দামের আশঙ্কা করছেন সচেতন ব্যক্তি ও ভোক্তারা। চাষিদের ভাষ্য, গতবছর পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছিল। সারাবছরও তেমন দাম ছিলোনা। তবে এখন পেঁয়াজের দাম ভাল। সেজন্য প্রায় ২০ দিন আগেই কাঁচা পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। জানা গেছে, সপ্তাহের প্রতি রোববার উপজেলার যদুবয়রা – পান্টি সড়কস্থ চৌরঙ্গী মহাবিদ্যালয় মাঠে বসে বড় পেঁয়াজ হাট। সকালে সরেজমিন হাটে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের দুপাশ জুড়ে ও বিশাল মাঠে বসেছে পেঁয়াজের হাট। শতশত কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অপরিপক্ব পেঁয়াজ কেনাবেচা করছেন। এসময় যদুবয়রা ইউনিয়নের জোতমোড়া গ্রামের ওহিদুল ইসলাম জানান, গত বছর সিজনে ( মৌসুম) লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলাম। এখন বাজারে দাম ভাল। সেজন্য সময়ের আগেই কাঁচা পেঁয়াজ তুলেছি। এক হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে সাড়ে তিন মণ বিক্রি করেছি। তাঁর ভাষ্য, দাম ভাল হলেও এখন পেঁয়াজ তুললে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১৫ মণ ফলন কম হচ্ছে। কৃষক লোকমান হোসেন জানান, অন্তত ২০ দিন পরে পেঁয়াজ তুললে ফলন ভাল পাওয়া যেত। কিন্তু অনেকের দেখাদেখি তিনিও অল্প জমির পেঁয়াজ তুলেছেন। তাঁর ভাষ্য, গত সপ্তাহের তিন হাজার ১০০ টাকা মণ দরে দুই মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলেন। তবে আজ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬০০ টাকা মণ। স্থানীয় পেঁয়াজ ব্যবসায়ী করিম মন্ডল জানান, আজ মান ও আকার ভেদে সর্বনিম্ন ৩০ ও সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তিনি প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ কিনেছেন। চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করবেন। তাঁর ভাষ্য, দামের লোভে কৃষকরা অপরিপক্ব পেঁয়াজ হাটে তুলেছে। ঝিনাইদহ থেকে হাটে আগত ব্যবসায়ী সিরাজ প্রামাণিক জানান, তিনি গত সপ্তাহে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ১০০ টাকা দরে প্রায় ৪৫০ মণ পেঁয়াজ কিনেছিলেন। কিন্তু আজকের বাজার অর্ধেক। বছরের শুরুতেই লোকসান গুণছেন তিনি। চৌরঙ্গী পেঁয়াজ হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. মিলন হোসেন জানান, কৃষকরা অপরিপক্ব পেঁয়াজ হাটে এনেছেন। মান ও আকার ভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যার দাম গত সপ্তাহের ৬০ থেকে ৭০ টাকা ছিল। তাঁর ভাষ্য, রোববারের প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ মণ পেঁয়াজ বেচাকেনা হয়েছে। তবে দাম কম থাকায় অনেক কৃষক পেঁয়াজ ফিরে নিয়ে গেছেন। দুপুরে যদুবয়রা, বাগুলাট ও চাপড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কিছু অসাধু কৃষক অসময়ের অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলছেন। এসময় বাঁশগ্রামের কৃষক আকুল বিশ্বাস জানান, গত বছর পেঁয়াজ চাষে লোকসান হয়েছে। এখন বাজারে দাম ভাল। কাঁচা পেঁয়াজ ওজনেও ভারি। সেজন্য অসময়েই পেঁয়াজ তুলছেন তিনি। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমান প্রায় ১৮ হাজার ২৪০ হেক্টর। তারমধ্যে ২০২৩ – ২০২৪ অর্থবছরে চার হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষাবাদের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময় বাজারে পেঁয়াজের চড়া দাম ছিল। সেজন্য কৃষক লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৩৯০ হেক্টর বেশি জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৭০৫ মেট্রিকটন। কিন্তু দামের লোভে কৃষকরা প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কুমারখালী নাগরিক কমিটির সভাপতি মো. আকরাম হোসেন জানান, লোভে পড়ে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুললে ফলন কমে যাবে। ফলে বছর শেষে পেঁয়াজের ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। সুতরাং প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৯০ হেক্টর বেশি জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। পেঁয়াজ পরিপক্ব হতে এখনও প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগবে। কিন্তু বাজারে দাম বেশি থাকায় কৃষকরা অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবণা রয়েছে। তিনি অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলার ব্যাপারে কৃষকদের নিরুৎসাহ করছেন। ইউএনও মাহবুবুল হক জানান, চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি কৃষি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।