কুমারখালী প্রতিনিধি ॥ “আমি বিপদে পড়ে খোকন মেম্বরের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম। কিন্তু মেম্বর আমার দায়িত্ব নেয়নি। পরে জমিওয়ালা এসে আমাকে অনেক মারধর করে। আরেকজন মাথার চুল কেটে দেয়। আরেকজন ভিডিও করেন। ওরা আমার পায়ে বাড়ি দিছে, হাতে বাড়ি দিছে” । গতকাল শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সকালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে বসে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মো. নাঈম শেখ (২৪)। গত ১৭ এপ্রিল রাতে কলা চুরির অভিযোগে তাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় লাঠি দিয়ে বেধরক মারপিট করে মাথার চুল কেটে দিয়ে ভিডিও ধারণ করেন স্থানীয়রা। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাতে সেই মারধর ও চুলকাটার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। নাঈম শেখ উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হোগলা গ্রামের মধ্যপাড়া এলাকার মৃত মানিক শেখের ছেলে। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক। তবে ফেসবুকে ভিডিও ছড়ালেও এ ঘটনায় এখনও থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ পড়েনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও এলাকাকাসী সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হোগলা বাজার থেকে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি গোপকগ্রাম যাওয়ার কথা বলে নাঈমের ভ্যানটি ভাড়া নেন। পরে ওই ভ্যানে অজ্ঞাত ব্যক্তির আরো দুইজন সহযোগী তাঁদের সাথে যুক্ত হন। এরপর পথিমধ্যে জোরপূর্বক ভ্যানটি থামিয়ে অজ্ঞাতররা কলা ভর্তি একটি সাদা বস্তা ভ্যানে তোলেন। সেসময় স্থানীয়রা চোর চোর বলে চিৎকার চেঁচামেচি করলে অজ্ঞাতরা ভ্যান থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। তবে ভ্যানচালক নাঈমকে আটক করে লাঠি দিয়ে মারপিট করে চুল কেটে দিয়ে ফোনে ভিডিও ধারন করেন স্থানীয়রা। সেসময় জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর সদস্য ( মেম্বর) মো. খোকন উপস্থিত ছিলেন। ভিডিওটি ১৮ এপ্রিল রাতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিও তে দেখা যায়, কিছু উৎসুক জনতা বসে ও দাঁড়িয়ে আছেন। নাঈম বাঁচার জন্য আকুতি – মিনতি করছেন। তবুও একজন কাঠের লাঠি দিয়ে তাকে মারধর করছে। আর ভিডিওর শেষের দিকে কেচি দিয়ে একজনকে চুল কাটতে দেখা গেছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভ্যান চালক নাঈম বলেন, বেশি ভাড়া মিটিয়ে একজন লোককে নিয়ে গোপকগ্রাম যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে ওই লোক আরো দুজনকে আমার ভ্যানে তুলল। পরে তাঁরা জোরপূর্বক আমাকে মাঠের কোনায় থামিয়ে একটি সাদা বস্তা ভ্যানে তুলল। একটু পরে স্থানীয়রা চোর চোর বলে চেঁচামেচি শুরু করলে ওরা তিনজন ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। আর স্থানীয়রা তাকে ধরে মারধর করে চুল কেটে দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, সেসময় তিনি খোকন মেম্বরের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু মেম্বর তাকে আশ্রয় দেননি। পরে জমির মালিক মোঃ রওশন আলী (৪৫), সিরাজুল ইসলাম (৫০), রেজাউল ইসলাম (৩৫)সহ কয়েকজন তার পায়ের তালু, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেধড়ক মারধর করে এবং মোঃ সিরাজুল ইসলাম নামে একজন কেচি দিয়ে তার মাথার চুল কেটে দেয়। তবে থানায় অভিযোগ বা মামলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেননি বলে জানান নাঈম।
অপরদিকে এঘটনার পর থেকেই জমির মালিক রওশনসহ অন্যান্যরা গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। সেজন্য তাঁদের মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ইউপি সদস্য মো. খোকন জানান, চুরির খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। গিয়ে তিনি সবাইকে মারধর করতে নিষেধ করেছিলেন। তবে কেউ তাঁর কথা শোনেননি।
এবিষয়ে জানতে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল বাকী বাদশাকে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাবীব চৌহান জানান, ফেসবুকে তিনি ভিডিওটি দেখেছেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ঘটনা যাই হোক তাকে (নাঈম) পুলিশের কাছে সোপর্দ করা উচিৎ ছিল। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। এঘটনায় এখনও লিখিত অভিযোগ পড়েনি বলে জানান থানার উপ-পরিদর্শক ও জগন্নাথপুর ইউপির বিট পুলিশের কর্মকর্তা দিবাকর হলদার। তিনি জানান, কলা চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভ্যানচালককে মারপিট ও চুল কেটে দিয়েছে স্থানীয়রা। বিষয়টি তিনি সবই জানেন। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।