1. admin@andolonerbazar.com : : admin admin
  2. andolonerbazar@gmail.com : AndolonerBazar :

নিরাপদ উপায়ে পানের বালাই দমন

  • সর্বশেষ আপডেট : রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

 

কৃষি প্রতিবেদক ॥ অর্থনৈতিক বিবেচনায় পান একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। কোনো কোনো আদিবাসীদের প্রধান ফসল। যারা পান-সুপারি পছন্দ করেন, তাদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত পান খান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভোজের শেষে বিশেষ আপ্যায়নের তালিকায় এর স্থান থাকে সবার ওপরে। বাঙালিদের এই রেওয়াজ বহু পুরনো। এমনও বুড়াবুড়ি আছেন খাবার কম খেতে রাজি, কিন্তু প্রতিবেলা পান থাকতেই হবে। কেউ আছেন সারাক্ষণ পান চিবাতেই থাকেন। আবার এমনও আছেন যারা পান পছন্দই করেন না। পছন্দ অপছন্দ যাই হোক, পান কিন্তু শরীরের জন্য বেশ উপকারী। আছে অনেক গুণাগুণ। পুষ্টিবিদদের মতে, এর মধ্যে ২১ ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। তবে পানের সঙ্গে তামাক এবং জর্দা খাওয়া ঠিক নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কম বেশি পানের চাষ হয়ে থাকে। দেশে পানের মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর আর মোট উৎপাদন প্রায় ২.৫ লাখ টন। উৎপাদনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য জেলাগুলো হল: চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট এবং যশোর। অল্প পরিমাণ জমিতে পান চাষ করে যে লাভ আসে তা দিয়ে ৫ জনের একটি পরিবার সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারে। তাই পানবরজকে পারিবারিক ব্যাংক বলা যায়। দেশে-বিদেশে চাহিদার কারণে পানের বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পান বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশগুলো হলো: মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তবে পানের গুণগত মান ঠিক না থাকায় কয়েক বছর আগে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে ২০২১-২২ সাল থেকে আবারও পান রপ্তানি শুরু হয়েছে। পান যেহেতু কাঁচা অবস্থায়ই খেতে হয়। তাই এর আবাদ হওয়া চাই শতভাগ নিরাপদ। তা না হলে শরীরে বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা থাকে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে পান ক্ষতিকর পণ্য হিসেবেই গণ্য হবে। হয়ে যাবে রপ্তানি বন্ধ। আর এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ওপর। এসব কথা বুঝতে পেরে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের  কেউ কেউ এখন জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। তাদের উৎপাদিত পানের চাহিদাও  বেশ। তাই উন্নত পদ্ধতি এবং নিরাপদ উপায়ে ভালো জাতের পান উৎপাদন করলে ফলন  যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিদেশে রপ্তানির করে পাওয়া যাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।  পোকামাকড় এবং রোগবালাই পানের প্রধান সমস্যা। এসব দমনে কৃষকরা ইচ্ছেমতো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করেন। আর তা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাজারজাত করা হচ্ছে। এভাবে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরে। সম্প্রতি গবেষণাগারে পান পরীক্ষা করে এ ধরনের ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই পানের বালাই দমনে নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বরিশালের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পান ফসলে আক্রমণকারী বারো প্রজাতির পোকামাকড়, চার প্রজাতির রোগ এবং এক প্রজাতির অন্যান্য বালাই শনাক্ত করা হয়েছে। পোকাগুলো হলো: কালোমাছি পোকা, সাদামাছি পোকা, পাতা খেকো লেদা পোকা, সাধারণ কাটুই পোকা, ছাতরা পোকা, মিলিবাগ, জাব পোকা, থ্রিপস পোকা, পানের শোষক  পোকা, উইপোকা এবং ঘাস ফড়িং। মাকড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র মাকড়। রোগগুলো হলো: পাতা পচা, পাতার দাগ বা ক্ষতরোগ, লতা কিংবা গিট বা কান্ড পচা এবং গোড়া বা মূল পচা রোগ এবং অ্যানথ্রাকনোজ অন্যতম। আর শামুক হচ্ছে অন্যান্য বালাই। সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকার হচ্ছে কালোমাছি। দক্ষিণাঞ্চলের অনেকেই স্থানীয়ভাবে কালো কইতরী পোকা হিসেবে  চেনেন। পানের কালোমাছি পোকা শুষ্ক মৌসুমে বেশি আক্রমণ করে থাকে। সাধারণত মার্চ- মে এবং আগস্ট-অক্টোবর মাসে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তবে বর্ষা ও শীত মৌসুমে উপস্থিতি কম থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকা ও বাচ্চা উভয়ই পানের কচিপাতার নিচের অংশ এবং কচি ডগা থেকে রস চুষে খায়। ফলে পানের পাতা কুঁকড়ে বিকৃতরূপ ধারণ করে। সেইসাথে বাদামি বর্ণের দাগ পড়ে। এতে পাতার আকার ছোট হয়ে যায়। তাই এই পোকা দমন জরুরি। আর তা নিরাপদ উপায়েই সম্ভব। এ কাজের উপযুক্ত সময় হচ্ছে মার্চ মাস। তখন পানের বরজে হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য হেক্টরপ্রতি ৪০টির মতো ফাঁদ প্রয়োজন হবে। এ ধরনের ফাঁদ তৈরি করা অত্যন্ত সহজ। প্লাস্টিকের বৈয়মে হলুদ রং করে তাতে মবিল লেপ্টে দিলেই হয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির সিট আকৃতির ফাঁদ বাজারে পাওয়া যায়। যদি আক্রমণের মাত্রা বেশি হয়, তখন জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করা দরকার। এক্ষেত্রে একবার ফিজিমাইট এবং পরের বার বায়োক্লিন প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে পানের লতা এবং পাতা ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এছাড়া ফিজিমাইট (১ মিলি./ লিটার) এবং সাকসেস প্রতি লিটার পানিতে ১.২ মিলি. হারে একই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এভাবে ১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার করতে হবে। এ কাজ এপ্রিল-মে মাস এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে করলে সুফল পাওয়া যায়। পাতা  খেকো লেদা পোকা দমনে জন্য গাছের গোড়ায় প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম লাইকোম্যাক্স ¯েপ্র করতে হবে। বিকল্প হিসেবে হেক্টরে ৭ কেজি হারেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সাকসেস ১.২ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পানপাতায় ¯েপ্র করা যাবে। পানের লতা ও কান্ড পচা রোগের জন্য মে-আগস্ট মাস পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর পর্যায়ক্রমে লাইকোম্যাক্স প্রয়োগের পাশাপাশি ট্রাইকোডার্মা কিংবা চুন, তুঁতে আর পানি (১:১:১০০) দিয়ে তৈরি বর্দোমিক্সার ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া পাতা পচা রোগের জন্য ডাইনামিক ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে বরিশাল অঞ্চলের ৬ জেলার ১৩ উপজেলার ১৫ হেক্টর বরজে নিরাপদ পান উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আশপাশের পানচাষিদের মধ্যেও। তারা এখন বেশ উৎসাহিত। নিরাপদ পান উৎপাদনের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চাষকৃত গুরুত্বপূর্ণ ফল, পান, সুপারি ও ডাল ফসলের পোকামাকড় শনাক্তকরণ ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তার নামে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে ফসলের ৫ ধরনের পোকা দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হলো: নারিকেল গাছে বিধ্বংসী সাদা মাছি ও পোকার আক্রমণে নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, নারিকেলে মাকড়ের আক্রমণ ও সমন্বিত নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, আমড়া পাতার বিটল পোকার আক্রমণ ও নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, মুগডালের ফুলের থ্রিপস এবং ফুল ও ফল ছেদক পোকাসমূহের দমন ব্যবস্থাপনা এবং পানের কালোমাছি পোকার নিরাপদ  জৈবিক দমন ব্যবস্থাপনা। যে কোনো প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়। তাই রোগপোকা প্রতিরোধে পানের বরজ পরিষ্কার রাখতে হবে। সেই সঙ্গে দরকার সুষ্ঠু সার ব্যবস্থাপনা এবং সময়মতো যতœ-আত্তি। এছাড়াও চাই নিয়মিত পরিদর্শন। এর মাধ্যমে পান ফসল থাকবে অনুকূলে। সম্প্রতি উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অল্পখরচে এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে  কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই পানের কালো মাছিসহ অন্যান্য পোকার উপদ্রব খুব সহজেই দমন করা যাবে। এছাড়া বালাইও থাকবে নিয়ন্ত্রণে। ফলে পানের শতকরা ৫৫-৫৮ ভাগ ফলন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। তাই নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদনে লাগসই এই প্রযুক্তিগুলো সারাদেশে সম্প্রসারণ করা দরকার। এতে কৃষকের আয় বাড়বে। হবে জীবনমানের উন্নয়ন। আর জাতীয় অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

লেখক: নাহিদ বিন রফিক, টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল।

 

Please Share This Post in Your Social Media

আরো খবর
© All rights reserved ©2021  Daily Andoloner Bazar
Site Customized By NewsTech.Com