আ.ফ.ম নুরুল কাদের ॥ আজ রমজানুল মোবারকের তের তারিখ। এ মাসে নাজিল হয়েছিল বনি আদমের ইহ ও পরকালীন মুক্তি ও সাফল্যের চূড়ান্ত নির্দেশিকা গ্রন্থ আল কুরআনুল কারিম। এ মাসকে বছরের বাকি ১১ মাসের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী বলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কুরআন মাজিদ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন : রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, মানুষের জন্য পথনির্দেশ এবং স্পষ্ট নিদের্শনাবলি ও মানদন্ড হিসেবে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে-ই এ মাসটি প্রত্যক্ষ করবে, সে যেন এতে রোজা রাখে। আর যে অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে, সে অন্যান্য দিন থেকে এ সংখ্যা পূরণ করবে। [সূরা বাকারা : ১৮৫] কুরআন মজিদ নাজিল হওয়ার মাস হিসেবে রমজানের মর্যাদা অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি। শুধু শেষ নবীর প্রতি নয়, অনেক নবীর প্রতি কিতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছিল রমজান মাসে। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ওপর সহিফা নাজিল হয়েছিল রমজানের ১ তারিখে। আর রমজানের ৬ তারিখে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি তাওরাত, ১৩ তারিখে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি ইঞ্জিল এবং ২৬ তারিখে শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কুরআন মাজিদ নাজিল হয়েছে। কিন্তু হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে আছে যে, জবুর রমজানের ১২ এবং ইঞ্জিল ১৮ তারিখে নাজিল হয়েছিল। [ইবনে কাছির] মোটকথা রমজান মাসের সাথে আল্লাহর কিতাবের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই এ মাসে অন্যান্য নেক আমলের পাশাপাশি কুরআন মাজিদ পাঠ ও অধ্যয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। যারা অর্থ বুঝতে পারেন, তাদের পক্ষে তিলাওয়াতের স্বাদ অনুভব করার সুযোগ বেশি। তারা সুফল ও প্রতিদান বেশি পাবেন এতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু অর্থ বুঝতে না পারলেও শুদ্ধ উচ্চারণ ও শাব্দিক পাঠের মর্যাদাও কম নয়। কেননা কুরআন মাজিদ যেকোনো গ্রন্থ থেকে স্বতন্ত্র। আল্লাহর পক্ষ থেকেই কুরআনের শব্দাবলি ও বাক্যগুলো নাজিল হয়েছে। হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের বহন করে আনা পাঠই হুবহু সঙ্কলন করা হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এ গ্রন্থের অলৌকিকতা সুপ্রমাণিত, সুপ্রতিষ্ঠিত। বিন্যাস ও শৈলীর অসাধারণত্ব প্রশ্নাতীত। কারো পক্ষে অনুরূপ রচনা পেশ করা অসম্ভব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘকালে কারো পক্ষে এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়া সম্ভব হয়নি। এ জন্য অনেক দিন পর্যন্ত অন্য ভাষায় কুরআন মজিদের অনুবাদ করার পক্ষপাতী ছিলেন না মুসলিম মনীষীরা। তবুও ইসলামের প্রসারের কারণে অনারব জাতিগোষ্ঠীর কাছে আল্লাহর কিতাবের মর্ম ও ইসলামের শিক্ষা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা কুরআন-হাদিস অনুবাদের প্রধান প্রণোদক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অনুবাদে মূল গ্রন্থের ভাব ও সৌন্দর্য রা করা যায় না। এ নিয়ম অন্যান্য গ্রন্থের বেলায় প্রযোজ্য; আল কুরআনের ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। অতএব কুরআন মাজিদের মূল আরবি পাঠের গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তাছাড়া কুরআনের রয়েছে সম্মোহনী ও প্রভাবক শক্তি। অর্থ না বুঝে পাঠ করলেও তা পাঠকের হৃদয় ও মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। মাহে রমজানের সাথে কুরআন মাজিদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই পবিত্র এ মাসে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত ও অধ্যয়নে যথাসম্ভব বেশি সময় ব্যয় করার চেষ্টা করা উচিত। মনীষীরা রমজান মাসে নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে কুরআন মাজিদ তেলাওয়াতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অনেকে এ মাসে এতবার কুরআন মাজিদ খতম করেছেন, যা আমাদের বর্তমান ব্যস্ত যুগের বিবেচনায় অতিরঞ্জন মনে হয়। এমন মহিয়সী নারীর কথাও জানা যায়, যিনি রমজানে ৪০ বার কুরআন মাজিদ খতম করতেন। আর ৭, ১০ ও ১২ বার খতম করতেন এমন মুসলিম শাসক ইতিহাসে কম নন। এই রমজান মাসেই কুরআন খতমের মধ্যদিয়ে তারাবী নামাজের আয়োজন থাকে সর্বত্র। আল্লাহপাক রমজান মাসে বেশি পরিমান কুরআন তেলাওয়াত এবং কুরআনকে বুঝার তৌফিক আমাদের সকলকে দান করুন। আমিন।