কৃষি প্রতিবেদক ॥ রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার একটি ইংরেজি শব্দ। এই শব্দটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা শব্দে মিশে এখন অনেকটাই বাংলার কৃষকের কাছে পরিচিত। এই যন্ত্রটি ধানের চারা রোপণ পদ্ধতিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। ধানের চারা রোপণ মৌসুমে শ্রমিক সংকট বৃদ্ধি, ফসলের মধ্যবর্তী সময় হ্রাস, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হচ্ছে এই যন্ত্রটি। তাছাড়া একজন কৃষক প্রথাগত পদ্ধতিতে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক শতক জমিতে চারা রোপণ করতে পারে সেখানে একটি চার সারি বিশিষ্ট রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতক এবং ৬ সারি বিশিষ্ট যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৪৫-৫০ শতক জমিতে চারা রোপণ করা যেতে পারে। ফলে কৃষকের খরচ ও সময় দুটোই কম লাগে চারা রোপণের আধুনিক এই যন্ত্রটি ব্যবহারে। রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারে রোপণে চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ঠিক রাখা যায় এবং অল্প বয়সের চারা রোপণ করা যায়- যা ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া সারিতে লাগানো ধানের জমিতে পরিচর্যা করা সহজ হয়। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলায় উৎপাদিত ধানের চারা এই যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণ করা যায় না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কার্যকর রোপণের পূর্বশর্ত হলো সঠিকভাবে মেশিনের উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে ট্রে বা পলিথিনে চারা উৎপাদন করতে হয়। পলিথিন বা ট্রেতে উৎপাদিত এই চারা ‘ম্যাটটাইপ’ চারা হিসেবে পরিচিত। এই চারা সংগ্রহ এবং রোপণের সময় চারার শিকড়ের ক্ষতি হয় না। ট্রে ব্যবহার করে চারা উৎপাদনের জন্য চাষের জমির প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির আঙিনা, উঠুন বা মাচায় চারা উৎপাদন করা যায়। এমনকি ট্রেতে উৎপাদিত চারা সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। তাই বন্যা কিংবা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও চারা উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর উৎপাদিত চারা আমন মৌসুমে ১৫-১৮ দিন এবং বোরো মৌসুমে ২৫-৩০ দিন বয়সে রোপণ করা যায়। যে কারণে ধানের জীবনকাল মাঠে বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়। ফলে ধানের গোছায় বেশিসংখ্যক কার্যকরী কুশি উৎপন্ন হয়। চারার উচ্চতা, ঘনত্ব এবং ট্রে বা পলিথিনের উপর মাটির পুরুত্ব ম্যাটটাইপ চারা উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিকের রিজিড, ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিনের উপর ম্যাটটাইপ চারা তৈরি করতে হয়। ঝুরঝুরে দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ম্যাটটাইপ চারা তৈরির জন্য উপযোগী। প্রয়োজন মতো জৈবসার মাটির সঙ্গে মিশ্রণ করা যেতে পারে। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর পৌনে এক ইঞ্চি (০.৭৫ ইঞ্চি) গভীরতায় ঝুরঝুরে মাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দেয়া মাটির উপর ধানের জাত এবং অঙ্কুরোদগমের হার অনুযায়ী ১২০ থেকে ১৪০ গ্রাম পরিমাণ বীজ প্রতি ট্রেতে সমঘনত্বে ছিটিয়ে দিতে হবে। চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ১২০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ১৩০ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ১৪০ গ্রাম বীজবপন করতে হবে। একটি ট্রের ক্ষেত্রফল পৌনে দুই বর্গফুট (১.৭৫ বর্গফুট)। পলিথিনে বীজবপনের ক্ষেত্রে ১.০ বর্গফুট জায়গায় চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ৭০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ৭৫ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ৮০ গ্রাম হিসাবে বীজবপন করতে হবে। চারা তৈরির জন্য ব্যবহৃত বীজ ধানের অঙ্কুরোদগমের হার ৯০ ভাগ বা আরো বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আউশ এবং আমন মৌসুমে ধান চাষাবাদের জন্য সাধারণত ১৫-৩০ চৈত্র এবং ১৫ আষাঢ়-১৫ শ্রাবণ বীজবপন করা হয়। ওই সময়ে আবহাওয়া উষ্ণ থাকায় ম্যাটটাইপ চারা তৈরিতে কোনো সমস্যা হয় না। বোরো মৌসুমে ধানের জাত, জীবনকাল এবং এলাকা অনুযায়ী ১৫ কার্তিক-২৫ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত চারার জন্য বীজবপন করা হয়। বীজবপনের সময় আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় এবং প্রায়শ শৈত্যপ্রবাহ দেখা দেয়ায় ম্যাটটাইপ চারার বিশেষ যতœ নিতে হয়। বোরো মৌসমে ম্যাটটাইপ চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করলে ভালো এবং সুস্থ্যমানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব। ধাপসমূহ হলো-রোপণের পরিকল্পনা অনুযায়ী পলিথিনে অথবা রিজিড, ফ্লেক্সিবল প্লাস্টিক ট্রেতে চারা তৈরি করতে হবে, বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৯০ ভাগের কম হলে প্রয়োজন মতো অতিরিক্ত বীজ ট্রেতে বপন করতে হবে, পানি দিয়ে বীজ ভিজানোর সময় পানির উপর ভাসমান চিটা ধান আলাদা করে নিতে হবে। বীজ শোধন করার জন্য অ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্র“পের ছত্রাকনাশক যেমন: এমিস্টারটপ অথবা সেলটিমা (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ মিলি লিটার) দিয়ে ১৮-২০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে জাগ দিতে হবে। বীজ শোধন করলে ফসলে বীজবাহিত ছত্রাক রোগ, যেমন বাকানি, লিফস্পট, ব্রাউন স্পট, ফল্?সম্মাট ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ট্রের চারায় রোগবালাই দেখা দিলে অ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্র“পের ছত্রাকনাশক ২-৩ মিলি-লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে ¯েপ্র করতে হবে। ¯েপ্র করার পর আনুমানিক ছয় ঘণ্টা ট্রেতে সেচ দেয়া যাবে না। ¯েপ্র করার আনুমানিক ১২ ঘণ্টা পূর্বে ট্রের পানি সম্পূর্ণভাবে নিষ্কাশন করতে হবে, বাড়ির আঙিনায় অথবা উঁচু জায়গায় ট্রে স্থাপন করলে প্রতিদিন ঝর্ণার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সিক্ত করে পানি দিতে হবে। তবে মূল জমিতে ট্রে স্থাপন করলে চারার গোড়া পর্যন্ত সেচ দিয়ে পানি ধরে রাখতে হবে, যদি তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি বা তার কম থাকে সেক্ষেত্রে বিকালে পানি দিয়ে সকালে তা ছেড়ে দিতে হবে। শীতের কবল থেকে চারা রক্ষা করার জন্য পলিথিনের শেড ব্যবহার করা উত্তম। পলিথিনের শেড অবশ্যই মাটি হতে ২-৩ ফুট উঁচু অর্ধগোলাকৃতির হতে হবে এবং দিনের বেলায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। তবে প্রচন্ড এবং অত্যধিক কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায়, যদি শৈত্যপ্রবাহ থাকে, সেক্ষেত্রে পলিথিন দিয়ে চারা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ঢেকে রাখাই উত্তম, (৭) মাটি কম উর্বর হলে বা চারার বাড়বাড়তি কম হলে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০ গ্রাম এমওপি, ৪০ গ্রাম থিওভিট, ৩০ গ্রাম দস্তা সার ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে চারার উপর এমনভাবে ¯েপ্র করতে হবে যাতে সম্পূর্ণ চারা এবং মাটি ভিজে যায়। এটি মূলত চারা গজানোর ৫-৭ দিন পর করলেই উত্তম। তারপরও চারার বাড়বাড়তির ঘাটতি দেখা দিলে উল্লিখিত মাত্রায় আবারও ¯েপ্র করতে হবে। সবগুলো ট্রে একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায় ¯েপ্র করতে হবে। দিনের বেলায় ¯েপ্র করতে হবে যাতে চারার পাতায় লেগে থাকা শিশির পানি সূর্য ডুবার পূর্বেই শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশের কৃষিতে বর্তমান শ্রম সংকট বিবেচনা করে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার একটি প্রতিশ্র“তিবদ্ধ প্রযুক্তি।
লেখক ঃ ডক্টর মো. আনোয়ার হোসেন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭১০