1. admin@andolonerbazar.com : : admin admin
  2. andolonerbazar@gmail.com : AndolonerBazar :

খাদ্যসংকট মোকাবিলায় জাতীয় ফল কাঁঠাল

  • সর্বশেষ আপডেট : শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩

 

কৃষি প্রতিবেদক ॥ কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কারণ-সহজ প্রাপ্য, দামে সস্তা, পুষ্টিগুণ বেশি, আকারে বড় এমন একটি ফল পরিবারের সকলে মিলে খাওয়া যায়। কাঁঠালের কোনো অংশই অপ্রয়োজনীয় নয়। পাকা কাঁঠালের কোষ সুস্বাদু খাবার, বাকল গবাদি পশুর খাদ্য, বীজ ও কাঁচা কাঁঠাল তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কৃষক পরিবারে বসতবাড়ির আশপাশে কম-বেশি কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। একটি বড় গাছ থেকে শতাধিক কাঁঠাল পাওয়া যায়। কৃষকরা  মৌসুমে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে কাঁঠাল বিক্রির মাধ্যমে অর্থ আয় করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবং শিকাগো বোটানিক গার্ডেনের উদ্ভিদ জীববিদ্যা ও সংরক্ষণ বিভাগের শিক্ষক নাইরি জেরেগা বলেন, কাঁঠালের অনুকূল আবাস গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ফলটির ‘যথাযথ ব্যবহার’ নেই। মার্কিন এ গবেষকের বক্তব্যের সত্যতাও রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে একসময় বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হলেও এখন ফলটির কদর কমে এসেছে। অথচ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলে সম্ভাব্য খাদ্যসংকট মোকাবিলায় কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধি একটি সমাধান হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন।

বৃক্ষে জন্মানো ফলের মধ্যে কাঁঠাল সবচেয়ে বড়। বাংলা ভাষায় প্রবাদবাক্য আছে-‘কাঁঠালের আঠা’, ‘গাছে কাঁঠাল  গোঁফে তেল’ ইত্যাদি। কাঁঠাল আসাম ও বার্মার চিরসবুজ বনেও ফলে। কাঁঠালের আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা,  যেখানে আজো বুনো কাঁঠাল ফলে। কাঁঠাল এক প্রকারের হলদে রঙের সুমিষ্ট গ্রীষ্মকালীন ফল। কাঁচা কাঁঠালকে বলা হয় এঁচোড়। এটি প্রায় ১০০ পাউন্ড (৪৫  কেজি) পর্যন্ত হতে পারে। কাঁঠালগাছের কাঠ আসবাবপত্র তৈরির জন্য অত্যন্ত সমাদৃত। বাংলাদেশে কাঁঠাল নামে পরিচিত হলেও থাইল্যান্ডে কানুন, মালয়েশিয়ায়  নাংকা, চীনে পো লো মি, ভারতে কানঠাল/কাঁঠাল/পেনাসা এবং ভিয়েতনামে মিট নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ জোনাথান ক্রেন বলেছেন, কাঁঠালগাছ বহুবর্ষজীবী হওয়ায় এটি প্রতি বছর রোপণের প্রশ্ন আসে না। গ্রীষ্মকালীন একেকটা গাছে পাঁচ থেকে সাত বছর যাবৎ ফল ধরে। কোনো কোনো গাছে বছরে ১৫০ থেকে ২০০টি কাঁঠাল ধরে। বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ভারত, বিহার, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় ব্যাপকভাবে কাঁঠালের চাষাবাদ হয়। তবে ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যামাইকা প্রভৃতি দেশে সীমিত আকারে কাঁঠাল জন্মে। সারা বাংলাদেশে কম-বেশি জন্মালেও নওগাঁ, দিনাজপুর, সাভার, ভালুকা, মধুপুর ও সিলেট কাঁঠাল প্রধান এলাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এদেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন কাঁঠাল ফলে। তবে কদর এখন কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদনও কম হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতে চাষকৃত কাঁঠালের জাত হলো-গালা ও খাজা। গালা ও খাজা কাঁঠালের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে ‘রসখাজা’ নামে আরেকটি জাত আছে। এছাড়া আছে রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসি, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি জাতের কাঁঠাল। তবে এদের মধ্যে হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে, বাকিগুলো আছে ভারতে। আকার, ওজন, রং, স্বাদ ও  বৈচিত্রের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাঁঠালের স্থানীয় নাম রয়েছে।  যেমন, লাউয়ের মতো দেখতে কাঁঠালকে লাউ কাঁঠাল, মধু রঙের কাঁঠালকে মধুরসা কাঁঠাল, খাওয়ার অংশ শক্ত এমন কাঁঠালকে চাইলা কাঁঠাল, দুধের মতো স্বাদ ও রং এমন কাঁঠালকে দুধরসা কাঁঠাল বলা হয়ে থাকে। এছাড়া কাঁঠালের স্থানীয় নামের মধ্যে রয়েছে-বেল কাঁঠাল, শসা কাঁঠাল, হাজারী কাঁঠাল, কুমুর কাঁঠাল, টেমা কাঁঠাল, ঢেওয়া কাঁঠাল, গুতমা কাঁঠাল, টেপা কাঁঠাল, সারিন্দ কাঁঠাল, গালা কাঁঠাল, পানিরসা কাঁঠাল, দুধরসা কাঁঠাল, মধুরসা কাঁঠাল, চিনিরসা কাঁঠাল, তরমুজ কাঁঠাল, কুমুর কাঁঠাল, রসগোল¬া কাঁঠাল, দুইসিজন কাঁঠাল, বিন্দি কাঁঠাল, বাইল্যা কাঁঠাল, পাতা কাঁঠাল, বল কাঁঠাল, খাজা কাঁঠাল প্রভৃতি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ এক তথ্যে জানা যায়, ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে বিশ্বের ফল উৎপাদনের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এফএও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তারা বলেছে, অন্যতম পুষ্টিকর ফল কাঁঠালকে বলা হয় মাংসের বিকল্প। সারা বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে  বেশি কাঁঠাল হয় ভারতে, ১৮ লাখ টন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ, ১০ লাখ টন। পুষ্টিমানের দিক থেকে অন্যতম সেরা এই ফলের আমদানি খুব দ্রুত হারে বাড়াচ্ছে চীন। তারা মূলত উৎপাদনে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড  থেকে কাঁঠাল আমদানি করে। জাপান, মালয়েশিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কাঁঠাল আমদানির দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত তিনটি উন্নত কাঁঠালের জাত উদ্ভাবন করেছেন। রামগড়ের পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা  কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ প্রায় তিন বছর সফল গবেষণার পর বারি কাঁঠাল-৩ নামের বারোমাসি কাঁঠালের নতুন জাত উদ্ভাবন করেন। প্রত্যন্ত এলাকায় সারাবছর ফল  দেয়া একটি কাঁঠাল গাছের সন্ধান পাওয়ার পর রামগড় পাহাড়াঞ্চলে কৃষি গবেষণা  কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০১১ সাল থেকে এ গাছটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারা তিন বছর গাছটির সার্বিক তত্ত্বাবধান, পরিচর্যা ও জার্মপ¬াজম নির্বাচন করে একটি নতুন জাত উদ্ভাবনে সফল হন। এর মধ্যে বারি-১ জাতের উচ্চফলনশীল কাঁঠাল পাওয়া যাবে বছরের মে-জুন, উচ্চফলনশীল অমৌসুমি জাত বারি-২ কাঁঠাল পাওয়া যাবে জানুয়ারি-এপ্রিল এবং নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল বারোমাসি বারি-৩ পাওয়া যাবে সেপ্টেম্বর-জুন মাস পর্যন্ত।  উদ্ভাবিত এ তিনটি জাত সারা দেশেই আবাদযোগ্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংস-এর তথ্যে জানা যায়, কাঁঠালের জমি ক্রমান্বয়ে কমছে। কাঁঠাল উৎপাদনের তথ্যসারণিতে দেখা গেছে-২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৭৬ হাজার ২৯৫ হেক্টরে ১৭ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৯ মেট্রিক টন, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৭৯ হাজার ১২ হেক্টরে ১৬ লাখ ৯৪ হাজার ২০৯  মেট্রিক টন এবং ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৭৯ হাজার ৯৪৭ হেক্টরে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৯ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে।

গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, পশ্চিমা নানান দেশগুলোতে  বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিজ উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে সেসব দেশে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল চাষের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তারই প্রমাণ মিলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও জাতিসংঘের সতর্কীকরণ প্রতিবেদনে। তারা বলছে, গম ও ভুট্টা চাষ নির্ভর অনেক  দেশে আশঙ্কাজনকভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে। যার কারণে সেখানে খাদ্য ঘাটতির যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে এই সংকট মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা কাঁঠালের দিকে এখন দৃষ্টি দিয়েছেন। জেনে অবাক হবেন, ফিলিপাইনের মতো দেশ যেখানে খুব বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয় না। তারা ভিয়েতনাম থেকে কাঁঠালের হিমায়িত পাল্প নিয়ে ইনস্ট্যান্ট কুইক ফ্রিজ (আইকিউএফ) পদ্ধতিতে কাঁঠাল সংরক্ষণ করে নিজেদের চাহিদা পূরণ এবং রপ্তানিও করছে। আবার ভিয়েতনাম রপ্তানির পাশাপাশি কাঁঠালকে কাজে লাগাচ্ছে মুখরোচক খাবার তৈরিতে।

কাঁঠালকে বলা হয় গরিবের পুষ্টি। কারণ এত সস্তায় এত পুষ্টি উপাদান আর কোনো ফলে পাওয়া যায় না। কাঁঠালকে বিস্ময়কর ফল হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় উলে¬খ করা হয়েছে। বিস্ময়কর এই ফলটি বিশ্বের কোটি মানুষকে অনাহারের হাত  থেকে বাঁচাতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।

লেখক ঃ এস এম মুকুল, কৃষি ও অর্থনীতি বিশে¬ষক এবং উন্নয়ন গবেষক

Please Share This Post in Your Social Media

আরো খবর
© All rights reserved ©2021  Daily Andoloner Bazar
Site Customized By NewsTech.Com